আশিক তুমি ফিরে এসো

.
.

আশিক, তুমি ফিরে এসো। তোমার ছোট আম্মা একবার শুধু তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। খুব দুঃখ পেয়েছেন মনে হয় না। কালকের বাজারটা আমিই করেছি। খুচরা বাজার, লন্ড্রি, জুতা পলিশ এখন থেকে আমাকেই করতে হবে। তুমি আবার ফিরে এলে এগুলো তোমাকেই করতে হবে। দাঁতে দাঁত চেপে আর কয়েকটা দিন চালিয়ে নিতে পারবে না, বাবা?
টুম্পা জানাল, জন্মদিনের সেই সেলফিটা ফেসবুকে দিয়েছে। শ খানেক লাইক পড়েছে। ফেসবুক, লাইক আমি কিছু বুঝি না। বাবা, ওই ব্যবহারের পরও আমি টুম্পাকে বকতে পারিনি। আপন না হোক, তোমারই তো বোন। তুমি কি ছোট বোনের ওপর রাগ করে থাকতে পারবে, বাবা?
রুম্পাকে ওর খালামণি যে পুতুলটা দিয়েছিল, চারটা পেনসিল ব্যাটারি দিয়ে সুইচ চাপলে দুলদুল করে নাচত, আর ঘর ভরে যেত গানের শব্দে, ওটা ভেঙে ফেলেছে। ওর কোনো খেলনাই দুই দিনের বেশি টেকে না। অথচ সেদিনও তোমার ছোটবেলার গাড়ি, পুতুল, খেলনাগুলো শোকেস উজ্জ্বল করে রাখত। একটা খেলনাও তোমার হাতে ভাঙেনি। ওই রুম্পাটাই না একটা একটা করে হাওয়া করে দিল। সবাই কি তোমার মতো লক্ষ্মী হয়, বাবা?
তোমার প্রথম জন্মদিনের কথা মনে থাকার কথা না। তোমার মা বেঁচে ছিলেন সেদিন। পুরো ঘরটা আমরা এক স্বপ্নপুরী বানিয়েছিলাম। তোমার মা খুব সুন্দর আলপনা আঁকত। তোমার চেয়েও ভালো হয়তো। লাল-নীল বেলুনে ঝলমল করছিল চারদিক। তোমার মা খুব সুন্দর গানও জানত। আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও...।
আরও দুইটা জন্মদিন পরে অন্ধকার নেমে এল আমাদের ঘরে। তোমাকে ছোট একটা বোন এনে দিতে যেয়ে কী যে হলো। হাতে-পায়ে পানি এসে, প্রেসার বেড়ে খিঁচুনি হয়ে পাড়ি দিল ওপারে। তোমার তখন সাড়ে তিন বছর বয়স। গলাগলি জড়িয়ে দুজন মিলে কাঁদতাম সারা রাত। তোমার অশ্রুফোঁটা আমার কাছে মনে হতো হাবিয়ার তপ্ত স্রোত। একেকটা রাত ছিল আমাদের নরকবাস। তোমার কান্না আমি কেন যেন সহ্য করতে পারি না, বাবা।
এরপর তোমার একটা আম্মা এল, ছোট আম্মা। প্রথম কয়েকটা রাত তুমি আমাদের সঙ্গেই ছিলে। তুমি কখন এত বড় হয়ে গেলে, বাবা? বছর ঘুরতেই তুমি তখন বড় ভাইয়া। কত দিন টুম্পা তোমার কোলে পেশাব করেছে, তুমি পাল্টে দিয়েছ। রাত দুইটায় কান্নায় ঘুমুচ্ছে না, তুমি হেঁটে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছ। স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে চকলেট কিনে দিয়েছ। অনেক যত্নে সাজানো তোমার নিজের একেকটা খেলনা তুলে দিয়েছ, প্রথমে টুম্পা, পরে রুম্পার হাতে। ওরা একটা একটা করে ভেঙেছে। তুমি একটা একটা করে চুমু দিয়েছ। সেই টুম্পা এখন ক্লাস এইটে। আর সেদিনই রুম্পা পা দিল চারে। এই বয়সে টুম্পার হাতে স্মার্টফোন। অথচ বারো শ টাকার ফোন দিয়ে তুমি দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছ। সেই ফোন নিয়ে যখন টুম্পা পরিবারের একটা গ্রুপ সেলফি তুলছিল, আর তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে ছবির একটা কোনায়, আর তোমাকে সরে যেতে বলল, এইটা আমাদের পরিবারের সেলফি, তুমি সরো, তুমি আমাদের পরিবারের কেউ না, সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলে না, বাবা? আমি মাথাটা নিচু করে ফেলেছিলাম। ভিতু, মেরুদণ্ডহীন একটা আমি। তুমি কি কেঁদেছিলে? আমি তাকাতে পারিনি। তোমার কান্না আমার সহ্য হয় না, বাবা।
সকালবেলা উঠে দেখি তুমি নেই। ওরা কত দিন তোমাকে বকেছে, তুমি শুধু শুনে গেছ। টুম্পার সেই কথার আঘাতটা সহ্য করতে পারোনি, তাই না? কলিজার ঠিক মাঝখানটায় গিয়ে বিঁঁধেছে, বাবা?
আশিক, তুমি ভালো আছ তো বাবা? আমার আকুতি কি তোমার চোখে পড়বে? রাতে আমার ঘুম হয় না। তোমার বিছানাটায় বসে বসে কাঁদি। তোমার জামার গন্ধ শুঁকি। তোমার চিরুনির দাঁতগুলোয় আদর করি। আমি একটা নতুন ফোন কিনেছি, ক্যামেরা আছে। তোমাকে নিয়ে একটা সেলফি তুলব। তুমি আর আমি। তুমিই আমার পৃথিবী। আশিক, তুমি ফিরে এসো।
ফিরে আয় বাবা তুই। ফিরে আয়।
মাতুয়াইল, ঢাকা।