উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সন্ধি

প্রবণতাটা চোখে পড়ছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই। ইউরোপের দেশে দেশে উগ্র ডানপন্থীদের উত্থান ঘটছিল। একসময় মূলধারার রাজনীতির আশপাশে ভিড়তে না পারা উগ্রবাদী প্রান্তিক দলগুলো আইন পরিষদে ঢুকতে পারেনি। কারণ, জনগণের অতি ক্ষুদ্র অংশের সমর্থনই পেতে সক্ষম হয়ে এসেছে তারা। কিন্তু ধীরে ধীরে ছবিটা বদলাচ্ছে। ইতিমধ্যে কতটা বদলেছে, তা ফ্রান্সের মারিন লো পেন ও নেদারল্যান্ডসের খিয়ার্ট উইল্ডার্সের ইউরোপজুড়ে জোট গড়ার সাম্প্রতিক ডাক থেকে বোঝা যায়। ইউরোপের সবচেয়ে পরিচিত ও প্রভাবশালী উগ্র ডান নেতা এ দুজন।
অন্য ধর্ম বা জাতিগত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উসকানিমূলক প্রচারণা চালিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক চেতনা আর আকাঙ্ক্ষার বিস্তার ঘটাতে কমবেশি সক্ষম হয়েছে ইউরোপের উগ্র জাতীয়তবাদী চেতনার ধারকেরা।
যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসবাদী হামলা-পরবর্তী বদলে যাওয়া বিশ্বচিত্র এই প্রচেষ্টায় হাওয়া দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রণোদনা হিসেবে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে অর্থনৈতিক সংকট। মন্দাগ্রস্ত দেশগুলোর সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে অনেক দেশের। কর্মসংস্থান ও কল্যাণমূলক কর্মসূচির পড়ছে ভয়াবহ চাপ। এই দুর্গতির জন্য অনেকাংশে দায়ী করা হচ্ছে বিদেশি অভিবাসীদের। উগ্র জাতীয়তাবাদীদের চোখের বিষ হয়ে উঠেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তাদের মতে, ইইউভুক্ত ইউরোপের দেশগুলোর নিজের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। অর্থনীতি, মুদ্রানীতি, অভিবাসন—যা-ই হোক, ব্রাসেলস আর স্ট্রাসবুর্গের ইইউ নেতা আর কর্মকর্তারা ঠিক করবেন।
ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টের মারিন লো পেন ও হল্যান্ডের ফ্রিডম পার্টির নেতা খিয়ার্ট উইল্ডার্স আগামী বছরের মে মাসে অনুষ্ঠেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে আরও কিছু ইউরোপীয় সহযোগীকে নিয়ে একযোগে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। ১৩ নভেম্বর নেদারল্যান্ডসের পার্লামেন্ট ভবনের প্রেস সেন্টারে এই ঘোষণা দেন তাঁরা। এ নিয়ে ইউরোপের পত্রপত্রিকাগুলোয় সমালোচনার ঝড় ওঠে। ওলন্দাজ পার্লামেন্টে খিয়ার্ট ও লো পেনের সাক্ষাতের সময়ও মানবাধিকারকর্মীসহ উগ্রপন্থার বিরোধী অনেকে তাঁদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিগত ছয় দশক ধরে ইউরোপীয় রাজনীতি তাই মূলত চারটি ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে: রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক ধারা, সামাজিক গণতান্ত্রিক ধারা, উদার গণতান্ত্রিক ধারা এবং বাম রাজনৈতিক ধারা। এই মূল রাজনৈতিক ধারার বাইরে সাম্প্রতিক কালে উত্থান ঘটেছে পরিবেশবাদী সবুজ দলের। পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ধারার একাধিপত্যের বিলোপের বিপরীতে ঘটেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিস্তার। সাম্প্রতিক ইউরোপীয় রাজনৈতিক ধারায় মূলত রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দল ও সামাজিক গণতান্ত্রিক দল দুটিই ঘুরেফিরে বিভিন্ন দেশের ক্ষমতায় আসীন হচ্ছে। কোনো কোনো সময় এই দল দুটির সঙ্গে অনান্য ধারার ছোট দলগুলোও শরিক হচ্ছে। এ ধারার বাইরে ইউরোপের নানা দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কট্টর জাতীয়তাবাদী বা নব্য নাৎসি দলগুলো স্থানবিশেষে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এদের পুঁজি আমজনতাকে খুশি করার কৌশলী সস্তা স্লোগান, অভিবাসীবিদ্বেষী আস্ফাালন তথা ইসলামবিদ্বেষ। ইদানীং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপীয় ঐক্যের বিরোধিতা। এই কৌশল অবলম্বন করে এরা ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, গ্রিস, ইতালি ইত্যাদি দেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এরা স্থানীয় শহর পরিষদ বা প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনগুলোয় মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদ্বারত্ব করতে চাইছে বা করছে।
২০০৭ সাল থেকেই ইউরোপজুড়ে ‘ঐতিহ্য, পরিচয়, সার্বভৌমত্ব’ নামে উগ্র জাতীয়তাবাদী ফোরাম গড়ার চেষ্টা করেছিলেন ইতালির কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতো মুসোলিনির নাতনি আলেকসান্দ্রা মুসোলিনি, ফ্রান্সের জ্যঁ পেন, অস্ট্রিয়ার ইয়র্গ হেডার। তা সাফল্যের মুখ না দেখলেও এবার মাঠে নেমেছে নতুন প্রজন্মের উগ্র ডানপন্থীরা। ফ্রান্সে মারিন লো পেন বাবা জ্যঁ পেনের পর ন্যাশনাল ফ্রন্ট দলের হাল ধরেছেন। তিনিই প্যান ইউরোপীয় উগ্রপন্থার ঝান্ডা তুলে ধরছেন সমমনা খিয়ার্ট উইল্ডার্সকে নিয়ে।
২০১৪ সালের মে মাসে অনুষ্ঠেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে মারিন ও খিয়ার্ট ইউরোপের অন্য ডানপন্থীদের একজোট করার চেষ্টা করছেন। সুইডেন ডেমোক্রেটিক দলের সভাপতি জিমি আকেশন, বেলজিয়ামের ভলামস ব্লকের ফিলিপ ডেভেন্টার, অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টির নেতা হাইনজ ক্রিস্টিয়ান স্টার্খে ও ইতালির লিগা নর্দ দলের উমবের্তো বসির সঙ্গে আলোচনা সেরেছেন তাঁরা। এর বাইরে ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি, হাঙ্গেরির জবিক পার্টি ও জার্মানির ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক দলের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে। তবে এই উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলোর নানা অভিন্ন স্বার্থ থাকলেও, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বৈপরীত্য ও একান্ত নিজস্ব ধান্দাও আছে।
২৮টি ইউরোপীয় দেশের সমন্বয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্তিকে খর্ব করা, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত পূর্ব ইউরোপীয় দেশের বেকার মানুষের পশ্চিম বা মধ্য ইউরোপে এসে চাকরি খোঁজা বন্ধে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ এবং ইউরোপে বসবাসরত মুসলিমদের ইচ্ছামতো চলাফেরা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে চাপ দিচ্ছে ইউরোপের উগ্র ডান দলগুলো।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সংসদীয় দল করতে এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ সাতটি দেশের ন্যূনতম ২৫ জন সাংসদের প্রয়োজন। ২৫ জন সদস্য পাওয়া অসম্ভব না হলেও সাতটি দেশ থেকেই তা আসবে কি না, এ নিয়ে কিছু সংশয় রয়েছে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সমস্যাকে পুঁজি করে এ ধরনের দলগুলো দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও আশার কথা, সব জায়গাতেই রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে এরা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। ইউরোপীয় প্রচারমাধ্যম মারিন লো পেন ও খিয়ার্ট উইল্ডার্সের যৌথ ঘোষণাকে ‘মূলত জনপ্রিয় সস্তা স্লোগান দিয়ে ভোটার টানার চেষ্টা’ বলে আখ্যায়িত করেছে।