সূচনায় ব্যতিক্রম

করোনার দুঃসময়েও বাংলাদেশের তরুণেরা মেলে ধরছেন নিজেদের। নতুন বাস্তবতায়, নতুন উদ্যমে এগিয়েৃ চলছেন। জানান দিচ্ছেন তারুণ্যের অমিত শক্তি। বাংলা নববর্ষে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় তরুণ, যাঁরা এরই মধ্যে দেখিয়েছেন প্রতিভার স্বাক্ষর, তাঁদের নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ‘ছুটির দিনে’। ১৪২৮ বঙ্গাব্দেও উজ্জ্বল এমন তরুণদের হাজির করেছে ‘ছুটির দিনে’। যার মধ্যে ক্রীড়া ক্ষেত্রে আছেন ক্রিকেটার আকবর আলী

যুব বিশ্বকাপ হাতে আকবর আলী

টেস্ট অভিষেকের পর গত দুই দশকে আমাদের ক্রিকেটের অনেক উন্নতিই হয়েছে। কিন্তু একটা জায়গায় বড় দুর্বলতা এখনো রয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে ক্রিকেটারদের মানসিকতা। সেখানেই ব্যতিক্রম গত বছর বাংলাদেশকে যুব বিশ্বকাপ এনে দেওয়া অধিনায়ক আকবর আলী। তাকে দেখে মনে হয় আমাদের এখন এমন ক্রিকেটারই দরকার। সত্যি বলতে কি, আকবরের খেলা প্রথম দেখার পরই মনে হয়েছে, ওর সম্ভাবনা আছে। পরে কথাবার্তা বলে বুঝেছি ছেলেটার ক্রিকেটবোধ অন্য অনেক ক্রিকেটারের চেয়েই ভালো। আকবর খুব ঠান্ডা মাথার ক্রিকেটার। আমার বিশ্বাস, একদিন বাংলাদেশের বড় ক্রিকেটারদের তালিকায় নাম ওঠাবে সে–ও।

ক্রিকেটারদের চিন্তাশীল হওয়াটা জরুরি। আকবরকেও আমার সে রকমই মনে হয়। খেলাটা নিয়ে সে চিন্তা করে, ভাবে। যেকোনো ক্রিকেটারের মধ্যেই এটা থাকা দরকার। আকবর ক্রিকেটটা খেলে ম্যাচের পরিস্থিতি বোঝে। যত অভিজ্ঞ হবে, ততই ওর ধার বাড়বে। উইকেটকিপিংটাও করে ভালো। নিজেকে পরের ধাপে নিতে ব্যাটিংয়ে আরেকটু উন্নতি করতে হবে। আর অধিনায়ক হিসেবে তো ছেলেটা এককথায় অসাধারণ।

নির্বাচক হিসেবে আমাকে ক্রিকেটারদের সঙ্গে অনেক কথা বলতে হয়। তাদের ভাবনা, মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করি। দিন শেষে একজন মানুষই কিন্তু ব্যাট-বল হাতে মাঠে যায়। মানুষটা যেমন হবে, ক্রিকেটারও তেমনই হবে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন অর্থের ঝনঝনানি। সামনে হয়তো সেটি আরও বাড়বে। এসবের মধ্যে থেকেও একজন তরুণ ক্রিকেটার কীভাবে সঠিকভাবে বেড়ে উঠবে, সে প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। কে কীভাবে নিজেকে তৈরি করছে, সেটা দেখতে হবে। আমাদের ক্রিকেটেই তো এমন নাম অনেক আছে, যারা অর্থ, খ্যাতিতে পা পিছলেছে। দারুণ প্রতিভাবান কিন্তু নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণের অভাবে হারিয়ে গেছে। আকবরকে এসব ক্ষেত্রেও আমার ব্যতিক্রম মনে হয়। চিন্তাভাবনায় সমবয়সীদের তুলনায় অনেকটাই পরিণত। ভবিষ্যতের বড় ক্রিকেটার হয়ে ওঠার সব গুণই আছে ওর। শুধু প্রয়োজন নিজের প্রতি খেয়াল রাখা এবং আমরাও যেন তার সঠিক পরিচর্যাটা করতে পারি।

আজকের দিনে অনেকেই বিরাট কোহলিকে অনুকরণ করে। কিন্তু কোহলি এই পর্যায়ে কীভাবে এল, সেটা কেউ ভাবে না। কেউ কোহলি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা অনুসরণ করে না। কোহলির মতো হতে হলে একজন ক্রিকেটারকে যে রকম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, সেটাই তো নেই কারও মধ্যে! আমাদের মুশফিকুর রহিমের কথাই ধরুন। কঠোর পরিশ্রম করেই তো সে এই পর্যায়ে এসেছে এবং এখনো পরিশ্রম করে চলেছে। আকবরের মধ্যেও এটা আছে। নিজেকে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়ার সব রকম চেষ্টাই করে ও।

এসব দিক বিবেচনা করেই আকবরকে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক করা হয়েছিল। ওর চলাফেরা, কথাবার্তা, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ভঙ্গিমা, সতীর্থদের সামলানোর দক্ষতা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশেষ কিছু দেখেছি আমরা। তাকে নিয়ে আমাদের ভাবনাটা মিলে গেছে বিশ্বকাপে এবং তার আগে আমরা যে সিরিজগুলো খেলেছিলাম, সেগুলোতেও।

মনের দিক থেকেও ছেলেটা বেশ শক্ত। আপনারা জানেন, বিশ্বকাপের মধ্যেই তার বোন মারা গেল। সেমিফাইনাল ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর খবরটা আমিই তাকে দিই। দেখলাম ও মানসিকভাবে এতটাই শক্ত যে এমন দুঃসংবাদ শুনেও স্থির ছিল। খেলা থেকেও মনোযোগ হারায়নি। কোনো কিছু নিয়ে সংকল্প করলে আকবর সহজে সেটা ছাড়ে না। বিশ্বকাপ জয়ের সংকল্পটাও হয়তো তার মধ্যেই সবচেয়ে বেশি ছিল। ক্রিকেটীয় সামর্থ্য আর এসব মানবিক গুণ মিলিয়েই আসলে একটা ছেলে ভালো ক্রিকেটার হয়ে ওঠে। আকবরের মধ্যেও দুটোর ভালো সমন্বয় আছে।

আকবর বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। তবু সে নিজেকে তেমন একটা প্রকাশ করে না। খোলস থেকে বের হতে চায় না। আসলে দ্রুতই সে বুঝে গেছে যে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতলেও তার সামনে অনেকটা পথ বাকি। আকবর জানে, যুব বিশ্বকাপ জয়টা তার ক্যারিয়ারের একটি ধাপমাত্র। ক্রিকেটীয় দক্ষতায় নিজেকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার তাড়নাটা তাই ওর বেশি। এই তাড়নাই হয়তো একদিন আকবরকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। (অনুলিখিত)

লেখক: বিসিবির জুনিয়র নির্বাচক ও জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার