উত্তরের বাতিঘর কারমাইকেল কলেজ

প্রধান ভবনের পূর্ব দিকে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য। এটি উদ্বোধন করেছিলেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক
ছবি: মঈনুল ইসলাম

১০৫ বছরের পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজ। কলেজের বিশাল মাঠ, পুরোনো ভবনে জড়িয়ে আছে বহু স্মৃতি। করোনাকালের দীর্ঘ বন্ধের পর আবার ক্যাম্পাস খুলেছে, আবারও মুখর হয়ে উঠেছে ‘উত্তরের বাতিঘর’।

রংপুরের কারমাইকেল কলেজে এখন নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। শিক্ষক আছেন ১৮০ জন। উচ্চমাধ্যমিক, ডিগ্রি, সম্মান ও স্নাতকোত্তরে মোট ১৯টি বিষয়ে পড়ানো হয় এখানে।

এই কলেজে পড়েছেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম, দেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী ও তেভাগা আন্দোলনের নেতা মণিকৃষ্ণ সেন, দেশের প্রখ্যাত ছড়াকার রফিকুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, কবি ও নজরুল-গবেষক আবদুল হাই শিকদার, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হকসহ অনেকে।

প্রিয় ক্যাম্পাস ছেড়ে গেলেও অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থীই সুযোগ পেলে ফিরে আসেন চেনা সবুজ চত্বরে। ঘুরে দেখেন প্রিয় প্রাঙ্গণ। প্রতিবছর উৎসবমুখর পরিবেশে কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে ‘প্রাক্তন ছাত্র সমিতি’। পুরোনো-নতুন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দেখা হয়। এই সুযোগে পুরো রংপুর শহরেই উৎসবের আমেজ পাওয়া যায়।

১৯১৬ সালের ১০ নভেম্বর অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড ব্যারন কারমাইকেল এই কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তাঁরই নামানুসারে কলেজের নাম করা হয় ‘কারমাইকেল কলেজ’। শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন বাঙালি জমিদারের সহযোগিতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে এই কলেজে আইএ ও বিএ ক্লাস খোলার অনুমতি দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সময় থেকে প্রায় দুই বছর পর্যন্ত কলেজের পাঠদান চলে রংপুরের বর্তমান জেলা পরিষদ ভবনে। ১৯১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কারমাইকেল কলেজের মূল ভবনের উদ্বোধন করা হয়। প্রায় ৩০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ। কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন ড. ওয়াটকিন।

প্রধান ভবনের পূর্ব দিকে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য। এটি উদ্বোধন করেছিলেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। ৮ ডিসেম্বর কলেজ ঘুরে দেখা গেল খাবারের ক্যানটিন, ছেলেদের কমনরুমের দশা বড় করুণ। কলেজের জন্য এখনো নির্দিষ্ট কোনো মিলনায়তন ভবন নেই। প্রধান ভবনের ছোট মিলনায়তনেই আয়োজিত হয় নানা অনুষ্ঠান।

ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত হল আছে তিনটি—তাপসী রাবেয়া হল, বেগম রোকেয়া হল ও জাহানারা ইমাম হল। ছাত্ররা থাকেন জিএল (গোপাল লাল রায়), ওসমানী ও কেবি (কাশিম বাজার) ছাত্রাবাসে।

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের সুনাম আছে। ক্যাম্পাসের বিতার্কিকেরা অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও নিয়মিত বিতর্কচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। প্রতিবছরই টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছেন তাঁরা। পড়ালেখার পাশাপাশি সাহিত্য ও নাট্যচর্চাতেও শিক্ষার্থীরা অনেকে এগিয়ে আছেন। এ ছাড়া রক্তদানসহ নানা রকম কার্যক্রমে সক্রিয় কলেজের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানাল, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয় প্রতিবছর।

কলেজ অধ্যক্ষ আমজাদ হোসেন বলেন, ‘চলতি বছর উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো ২২ জন শিক্ষার্থী মেডিকেলে, ৩০ জন বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেও আমাদের ছেলেমেয়েরা ভালো ফল পেয়েছেন। আমাদের কলেজের শিল্পীরা নানা অনুষ্ঠানে গান গেয়ে প্রশংসা পেয়েছেন। এ ছাড়া প্রাক্তনেরা ছড়িয়ে আছেন দেশে-বিদেশে। কলেজের ঐতিহ্য যেন বজায় থাকে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’