এ শহর কতটা নারীর

একে তো গণপরিবহন অপ্রতুল, সেখানে ৯টি সংরক্ষিত আসনে বিপুলসংখ্যক নারীর প্রয়োজন না মেটাই স্বাভাবিক। সন্ধ্যা গড়ালেই একা চলাচল করা যায় না। শহরের পরিকল্পনা কিংবা নিয়মকানুন ঠিক করার সময় নারীর কথা কি আদৌ ভাবা হয়?

রাজধানীতে গণপরিবহনে উঠতে নারীদের ভোগান্তি প্রাত্যহিকছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

একটা...দুইটা...তিনটা—এভাবে প্রায় তিন–চারটি বাস ফারহানাকে ছেড়ে দিতে হয় রোজ সকালে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ফারহানা যূথী। প্রতিদিন সকালে বাড্ডা লিংক রোড থেকে ধরেন মহাখালীর বাস। পুরুষ যাত্রীদের ঠেলেঠুলে যদিও বাসের দরজা অবধি পৌঁছান, বাসের হেলপার সাফ জানিয়ে দেন, ‘মহিলা সিট খালি নাই।’ রবি থেকে বৃহস্পতিবার অফিসের সময় গণপরিবহনে চড়া যেন যুদ্ধে যাওয়ার শামিল, বলেন তিনি।

পল্টন মোড়ে দেখা গেল ভিন্ন আরেক চিত্র। সেখানে রাস্তা পার হচ্ছিলেন এক গৃহিণী, পুষ্পিতা সাহা। মোড়ের অর্ধেক হকারদের দখলে, বাকিটা রিকশার। ‘এখানে একা রাস্তা পার হওয়াই যায় না, বাচ্চা থাকলে তো কথাই নেই। ছোট বাচ্চা নিয়ে একা কোনো নারীর বাইরে বের হওয়া যেন অপরাধ। এই শহরটা আসলেই আমাদের নয়,’ পুষ্পিতার গলায় ক্ষোভ।

বাংলাদেশে যে নারীরা গণপরিবহনে চলাচল করেন, তাঁদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার।

এই নগর–পরিকল্পনায় ভাবা হয় না নারীর কথা। একে তো গণপরিবহন অপ্রতুল, সেখানে নয়টি সংরক্ষিত আসনে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা বিপুলসংখ্যক নারীর প্রয়োজন না মেটাই স্বাভাবিক। এসবের বাইরে আছে চলাচলে নিরাপত্তার অভাব। এখনো যেন বেশির ভাগ নারীর জন্যই সূর্যাস্ত আইন প্রযোজ্য। সন্ধ্যা গড়ালেই একা চলাচল করা যায় না। আশপাশ থেকে কানে আসে অশ্রাব্য সব শব্দ। আবার গণপরিবহনে কিংবা রাস্তার ভিড়ে সুযোগসন্ধানী নোংরা হাত স্পর্শ করে শরীর।

১৫ জন নারীর কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম, এই শহরের নিরাপত্তা ও যোগাযোগব্যবস্থা নারীবান্ধব কি না। অধিকাংশই বলছিলেন সকালে এবং বিকেলে অফিস ছুটির সময় গণপরিবহনে উঠতে তাঁদের প্রাত্যহিক ভোগান্তির কথা।

গণপরিবহনে চলাচল করেন এমন নারীদের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার হন
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বিশ্বব্যাংকের ‘জেন্ডার-ইনক্লুসিভ আরবান প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন হ্যান্ডবুক’ একটি শহরের ছয়টি মূল বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে—সুযোগ-সুবিধার প্রাপ্যতা, চলাচলের পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা, সহিংসতা থেকে রক্ষা, জলবায়ু সহনশীলতা এবং বাসিন্দাদের নিরাপত্তা।

যে নারীরা অফিসের কাছেই থাকেন কিংবা যে মা বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করেন কিংবা বাজার করতে বের হন, তাঁরাও নানা দৈনন্দিন সমস্যার কথা বলেছেন। চলাচলের যোগ্য ফুটপাত কিংবা খোলা জায়গার অভাবের কথাও উঠে এল তাঁদের বক্তব্যে।

সারাহ দীনা পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ যোগাযোগ নির্বাহী হিসেবে কাজ করছেন। প্রায়ই ঢাকার নীলক্ষেতের রাস্তায় চলাচলের অভিজ্ঞতা থেকে বলছিলেন, হকাররা এমনভাবে ফুটপাত দখল করে রাখেন যে এটুকু পথ তাঁর কাছে দুঃস্বপ্নের মতো লাগে। দীনা বলেন, হোক নীলক্ষেত বা কারওয়ান বাজার, এসব এলাকায় যেহেতু এমনিতেই ভিড় লেগে থাকে, ফুটপাতও দখল হয়ে গেলে সেটা যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষের জন্যই সমস্যার কারণ।

যে মায়েরা বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় চলাচল করেন, তাঁরা মনে করেন, ফুটপাতগুলো যথেষ্ট প্রশস্ত নয়। এমনিতেই জায়গা কম, সেটুকুও চলে যায় হকারদের দখলে।

এই প্রতিবেদনের জন্য তথ্য সংগ্রহের সময় এক মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর মেয়ের ক্লাস শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর কোলে এক বছর বয়সী আরও এক সন্তান। বলছিলেন, ‘ঢাকা শহরে এমন একটা রাস্তা অথবা ফুটপাত দেখান, যেখানে আপনি নিরাপদে আপনার বাচ্চাকে স্ট্রলারে বসিয়ে চলাচল করতে পারবেন।’

নিরাপত্তা নিয়ে নারীদের উদ্বেগ তো আছেই। সোনালী ব্যাংকের কর্মী নার্গিস নাহারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তিন নেতার মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ সামনে একটা মোটরসাইকেল থামল। মোটরসাইকেলের দুই যাত্রী উত্ত্যক্ত করা শুরু করল। রাস্তার আলো ছিল খুব কম। ওরা আমার শরীর, বেশভূষা নিয়ে বাজে মন্তব্য করছিল। অথচ আশপাশের মানুষ কেউ কিছু বলল না, প্রতিবাদ করল না।’

প্রতিবাদ করাও যে কখনো কখনো অপরাধ হয়ে যায়, সে কথা উঠে এল বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রীর বক্তব্যে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘মাস দুয়েক আগে বাসে চড়ে কলেজে যাওয়ার সময় এক লোক আমার গায়ের ওপর এসে পড়ছিল, গায়ে হাত দিচ্ছিল। যখন প্রতিবাদ করলাম, অন্য যাত্রী আর হেলপার উল্টো আমাকে দোষারোপ করতে লাগল। বলল এতই যদি সমস্যা থাকে, তো প্রাইভেট গাড়িতে চড়েন না কেন?’

২০১৮ সালে ‘নারীর জন্য নিরাপদ সড়ক: বাংলাদেশে যৌন হয়রানি ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধ’ শীর্ষক ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে যে নারীরা গণপরিবহনে চলাচল করেন, তাঁদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার।

বিশ্বব্যাংকের হ্যান্ডবুক-ও বলছে, ‘২০১৫ সালে হওয়া নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা জরিপ অনুযায়ী, কর্মস্থল এবং স্বামীর বাড়ির পর বাংলাদেশের নারীরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন গণপরিবহনে বা রাস্তায় (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০১৬)। ’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, ‘মূল সমস্যাটা হলো, আমাদের দেশে কোনো পর্যায়ের মানুষই লিঙ্গ সংবেদনশীলতার ব্যাপারে অবগত নয়। পেশাগতভাবে আমরা যখন নগর-পরিকল্পনা বিষয়ে কোনো কর্মশালা করি, দেখি জেন্ডার ইনক্লুসিভিটি নিয়ে কেউ কথা বলে না। আমাদের পরিবার বা সমাজে এ বিষয়ে সচেতনতা নেই। আমাদের পাঠক্রমে এ–সংক্রান্ত কিছু নেই। মেয়েরা ঘরে থাকবে—আমাদের মনের ভেতরে এই ধারণাই এখনো দৃঢ় হয়ে বসে আছে।

‘যদি আপনার গণপরিবহনের সংখ্যা যথেষ্ট হয়, তাহলে তো আর সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন পড়ে না। যদি সড়কবাতিগুলো ঠিকমতো বসানো হয়, তাহলে হয়তো অপরাধের পরিমাণ কমবে। নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত সবার জন্যই পাবলিক প্লেসগুলো নিরাপদ করা।’

ফ্রান্স, তিউনিসিয়া, অস্ট্রিয়া বা ভারতে বেশ কিছু শহর আছে, যেগুলোর নকশা ও পরিকল্পনা করার সময় নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার কথাই ধরা যাক। লিঙ্গ সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রেখেই সাজানো হয়েছে এই শহর। ১৯৯০ সালে নগর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন নারী-পুরুষকে প্রশ্ন করেছিলেন, কোন রাস্তা কিংবা কোন পরিবহন তাঁরা ব্যবহার করেন, কেন করেন, ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের ভিত্তিতে তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, শহরে চলাচলের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের চাহিদা একেবারে ভিন্ন। অতএব তাঁরা একটু ভিন্নভাবে শহরের নকশা ও পরিকল্পনা করেছেন। পায়ে হাঁটার পথগুলো প্রশস্ত করেছেন, যান চলাচলের পথগুলোর নকশা নতুন করে সাজিয়েছেন, জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থান এবং উজ্জ্বল সড়কবাতির সংখ্যা বাড়িয়েছেন, চলাচলের পথে প্রয়োজনে মায়েরা যেন সন্তানকে দুধ খাওয়াতে পারেন—সে রকম জায়গা রেখেছেন, সর্বোপরি এই সবকিছু বাস্তবায়নের জন্য আলাদা বাজেট করা হয়েছে। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে এখন পর্যন্ত ৬০টির বেশি লিঙ্গ সংবেদনশীল পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ভিয়েনা, ভাবনায় আছে আরও প্রায় এক হাজার প্রকল্প।

লিঙ্গকে বিবেচনায় নিতে হলে নীতি, আইন, এবং সম্পদ বরাদ্দ—সব ক্ষেত্রেই নারী ও পুরুষের সমান ভাগ থাকা উচিত। ১৯৯৫ সালে নারী-পুরুষ সমতা বিষয়ে জাতিসংঘ নির্ধারিত বৈশ্বিক পরিকল্পনায় এমনটাই বলা হয়েছে।

মহিলা পরিষদের প্রেসিডেন্ট ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘জেন্ডারের ধারণা একটা শহরের মূলনীতিতেই থাকা উচিত। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কিছু অগোছালো পরিকল্পনা করেন, যেগুলো আদতে কার্যকর নয়। নারীদের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে পরিবহনব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেট, রুট প্ল্যান করা, ডে কেয়ার সেন্টার রাখা তো দূরের কথা।’

ফওজিয়া মোসলেম জানালেন, বেশ কয়েকবার তাঁরা শহরের কাউন্সিলরদের সঙ্গে বসেছেন। স্থানীয় সরকার ও পৌরসভা–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও নারী সংবেদনশীল শহর বিষয়ে তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। সিটি নির্বাচনের আগেও তাঁরা বেশ কিছু দাবিদাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। ফওজিয়া মনে করেন, যদি নারী কাউন্সিলরদের যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে তাঁদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে ঢাকাকে নারীবান্ধব করা সম্ভব।

(প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে একাডেমির নারী সাংবাদিক মেন্টরশিপ কর্মসূচির আওতায় তৈরি। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মো. সাইফুল্লাহ)