এ সময়ের দিনলিপি
এখন আর ছুটি চাই না
এ বি আরিফ
রসায়ন বিভাগ, সরকারি বাংলা কলেজ, ঢাকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘নদীর এ পার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’। মহামারির সময়ে কথাটা যেন আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করছি। আমাদের মধ্যে না পাওয়ার একটা অপূর্ণতা সব সময় কাজ করে। যখন কোনো কিছু পাই, আরও পাওয়ার আশা করি। ভেবে নিই, আমি সবচেয়ে কষ্টে আছি, বাকিরা হয়তো ভালো আছে।
স্কুলে পড়ার সময় ভেবেছি, কলেজে উঠলেই অপার স্বাধীনতা। কলেজে পড়ার সময় ভাবলাম, স্নাতকে পড়লেই বোধ হয় পড়ার চাপ নেই, বকা দেওয়ার কেউ নেই। অথচ স্নাতকেও দেখি ক্লাস, পরীক্ষা লেগেই থাকে। নিজের পড়াশোনা, টিউশনি—সব মিলিয়ে দম ফেলার ফুরসত নেই। প্রায়ই ভাবতাম, এই ব্যস্ততা থেকে যদি দীর্ঘ একটা ছুটি পেতাম, মন্দ হতো না।
করোনাভাইরাসের প্রকোপে বন্ধ হলো সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। টিউশনিতে যাওয়াও বন্ধ হলো। ভাবলাম, বাহ, এবার আর খুশির সীমা নেই। এখন আর আটকায় কে! ইচ্ছামতো ফেসবুক ব্যবহার করব, ইউটিউব দেখব, সিনেমা দেখব। বেশ কয়েকটা নাটক-চলচ্চিত্রের একটা তালিকাও তৈরি করে ফেলেছিলাম।
প্রথম দুই সপ্তাহ ভালো কাটল। এরপরই বিরক্ত বোধ করতে শুরু করলাম। আর আরও ভালো করে উপলব্ধি করলাম কবি গুরুর কথাগুলো। যে ছুটির অপেক্ষায় ছিলাম বহুদিন ধরে, আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম, ছুটির চেয়ে ক্যাম্পাসের দিনগুলোই আমার কাছে বেশি প্রিয়।
ক্যাম্পাসের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় না অনেক দিন। বন্ধু, ছোট-বড় ভাইদের মিস করি খুব। ক্যাম্পাসের পেছনে লেকের পাশে বসে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডার সময়টা মনে পড়ে। লেকের পাড়ে প্রাকৃতিক বাতাস কিংবা পাখিদের কিচিরমিচির ডাক হৃদয়টা জুড়িয়ে দিত। সবুজ ঘাসের চাদর বিছানো খেলার মাঠটা প্রায়ই চোখে ভাসে। মাঝেমধ্যে ক্লাস শেষে বন্ধু মুশফিক বলত, ‘চল না, একটু ঘাসের ওপর বসে আড্ডা দিই।’ বিভাগের বড় ভাইদের স্নেহ, জুনিয়রদের হাসি কিংবা শিক্ষকের ক্লাস খুব মিস করি।
রাজনৈতিক বড় ভাইদের স্লোগানে মুখরিত ছিল প্রিয় কলেজ ক্যাম্পাস। ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনায় প্রতিটি বিভাগ ব্যস্ত সময় কাটাত। কলেজের যুব থিয়েটারে শোনা যেত, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ কিংবা তারানা নৃত্যের ঝংকার। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের রক্তদান কর্মসূচি, রোভার স্কাউটের সাহসী অনুপ্রেরণা কিংবা বিএনসিসির কড়া নিয়মানুবর্তিতা এখন আর চোখে পড়ে না। এখন আর পাল্টাপাল্টি বিতর্কে বিতর্ক ক্লাব জমে উঠে না। বটতলায় বসে না কেউ।
একদিন নিশ্চয়ই আবার ক্যাম্পাস খুলবে। আমাদের পথচলায় মুখরিত হবে প্রাঙ্গণ। তখন হয়তো আবার এই ছুটিই মিস করব!
ক্যাম্পাস থেমেছে, কিন্তু আমরা থামিনি
ফারদীন হক
হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর
আমাদের সেই ক্যানটিন, বিশাল বটগাছ, মামার ঝাল ঝাল ফুচকা, প্রিয় বন্ধুদের প্রিয় মুখ এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের পদধূলিমাখা ক্যাম্পাসে যেতে পারব না, ভেবেই দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হঠাৎ করে সব বন্ধ হয়ে গেল এবং আমরা পারি জমালাম এক অনিশ্চিত অন্ধকার সময়ে। আমি একজন আড্ডাপ্রিয় মানুষ। যুক্ত আছে ক্যাম্পাসের অনেক সংগঠনের সঙ্গে। তাই আমার দিন শুরু হতো ওই ১০০ বছরের পুরোনো কারমাইকেল কলেজে, আর দিনের শেষটাও সেখানে ছিল। আমাদের ক্যাম্পাসে উৎসব-উৎসব একটা ভাব থাকত সব সময়, কিন্তু হঠাৎ করেই সব থমকে গেল।
পড়াশোনা, পরীক্ষা ও আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে হঠাৎ করেই স্থবিরতা চলে এল। এক অজানা ভয় মনের ভেতরে। আমি আগে থেকেই অনলাইনে ব্যবসা করতাম। ফেসবুকে একটা অনলাইন ব্যবসাবিষয়ক পেজে ই-কমার্স নিয়ে লেখা শুরু করলাম। নতুন অনেক কিছু শেখা, শেখানোর সুযোগ হলো। এক-দুজন করে কিছু মানুষ এই লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হচ্ছিল, যা আমাকেও অনুপ্রাণিত করেছে।
হঠাৎ লক্ষ করলাম, ক্যাম্পাসের সেই প্রিয় মুখগুলো নতুনভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে। কেউ ছবি আঁকছে, কেউ গান করছে, আর কেউবা আমার মতো উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। কিছুদিন যেতে না যেতেই শিক্ষকেরা অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। করোনাভাইরাস না এলে আমার হয়তো কখনোই জানা হতো না, আমাদের ক্যাম্পাসের জুনিয়র-সিনিয়র ভাইবোনদের মধ্যে এত প্রতিভা লুকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে হতাশা কাটিয়ে একসঙ্গে বাঁচতে শিখলাম আর আশায় দিন গুনতে থাকলাম, খুব দ্রুত ফিরব প্রিয় প্রাঙ্গণে। আবার হবে বসন্ত উৎসব, পয়লা বৈশাখ, বাংলা মঞ্চে আবার হবে প্রিয় কবিতা পাঠ। আবার আমরা প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেব, আমাদের সেই সবুজ ক্যাম্পাসে। কাঠগোলাপ ফুলটা মাথায় গুঁজে বলতে পারব চিৎকার করে—আমরা এখন ভালো আছি।
শেখা-শেখানোর সুবর্ণ সুযোগ
জান্নাতুল আলম
এসএসসি উত্তীর্ণ, আইডি য়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
না, করোনা আমাকে ক্যাম্পাস থেকে দূরে সরিয়ে দেয়নি। ক্যাম্পাস ছেড়েছি কোভিড-১৯ সংক্রমণের আগেই। কিন্তু নতুন ক্যাম্পাসে পা রাখার আগেই করোনা মহাশয় মাঝখানে এসে বসে পড়লেন। আমি এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। এই কারণেই বোধ হয়, শুরুর দিকে করোনার ওপর আমার রাগটা অন্যদের চেয়ে কিছুটা বেশিই ছিল। পরীক্ষা শেষে এটা করব ওটা করব ভাবাটা যে এত বড় বোকামি হবে, তা কী আমি আগে জানতাম।
সে যা–ই হোক, পড়াশোনায় সব সময় ফাঁকি দেওয়া চেষ্টা করেছি তা নয়, তবে পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কটা যে ভালোবাসার, তা-ও নয়। কিন্তু এই লকডাউনে আমার পড়াশোনার মধ্যে ফিরে যেতেও ভীষণ ইচ্ছা করেছে। সেরা কলেজ ভর্তির পড়া পড়ব নাকি উচ্চমাধ্যমিকের—এই ভাবতে ভাবতে অনেক হতাশার মুখেই পড়েছি। দিন শেষে দোষ আবার করোনার। না দিল আমাকে স্কুলে থাকতে, আর না দিল কলেজে উঠতে।
লকডাউন শুরু না হতেই না পড়া সব উপন্যাসগুলো পড়া শুরু করে দিয়েছিলাম, যার ফল মার্চের শেষেই প্রায় ৪০টি নতুন বই পড়া শেষ। তখনো ঠিক করে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়নি। একদিন এক বন্ধু বলল, তার পরিচিত কোনো এক বড় ভাই ফ্রি এইচটিএমএল কোর্স করাবেন। পেয়ে গেলাম একটা কাজ। ভাইয়ার কোর্সটা সত্যি খুব চমৎকার ছিল। তখন থেকেই বুঝলাম অনলাইন এডুকেশন ব্যাপারটা মন্দ না। এরপর একে একে সব জায়গাতেই অনলাইন ক্লাস শুরু হলো। তখন ভাবলাম, আমিও যা কিছু জানি, তা তো অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারি। অন্যের শেখা হবে, আবার নিজের চর্চাটাও হবে।
সেদিন রাতেই কথা বললাম এক জুনিয়রের সঙ্গে। কিছুদিন পর সেই জুনিয়রসহ তার ৪-৫ জন বান্ধবীকে নিয়ে প্রাথমিক ইংরেজ বলার ক্লাস নেওয়া শুরু করলাম। ধীরে ধীরে যোগ হলো উপস্থিত বক্তৃতা, বই সমালোচনা, গণিত ইত্যাদি। গণিত ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থাকার সূত্রে বেশ কয়েকবার স্কুলের ছাত্রীদের গণিতের ওপর কর্মশালা করানোর সুযোগ হয়েছে। তখন থেকেই অন্যকে শেখানোর ওপর একধরনের আগ্রহ কাজ করত। কে জানত তখন, এভাবে ঘরে বসেই কারও কাছ থেকে এমন করে শিখতে পারব এবং শেখাতেও পারব। এখন করোনার ওপর রাগটা কমেই এসেছে। আজকাল মনে হয়, জীবনের গতি একটু কমে গিয়ে নতুন করে সবটা শুরু হওয়া বুঝি খুব জরুরি হয়ে গিয়েছিল। আমিও এখন ভালোই আছি। নিজেকে ব্যস্ত রাখছি, আর অন্য কাউকে কীভাবে একটু সাহায্য করা যায়, তা নিয়েই ভাবছি।
স্নাতক পেরোনোর খুব কাছে গিয়েও আটকে আছি
রেজাউল ইসলাম
কৃষি অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ প্রায় পাঁচ মাস হলো। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম চলমান, তবু আমার মতো যারা ‘ঝুলে থাকা শিক্ষার্থী’, তাদের হতাশায় গা ভাসানো ছাড়া আর কীই–বা করার আছে। কয়েকটা ব্যবহারিক পরীক্ষা না হওয়ায় স্নাতক পেরোনোর খুব কাছাকাছি গিয়েও থমকে আছি।
কিছু যখন করার নেই, ভাবলাম কীভাবে সময়টা কাজে লাগানো যায়। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির অভ্যাস ছিল। সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতেই পারে। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠাতে শুরু করলাম। তরুণ লেখক হিসেবে নিজেকে ঝালাই করে নেওয়ার এটাই সময়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে গেলে আবার শুরু হবে ব্যস্ততা, তখন হয়তো সময় পাব না। তাই ঘরবন্দী সময়টা সঠিকভাবে ব্যবহার করাকেই এখন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ঈদ, পূজা অথবা সরকারি অন্যান্য ছুটি ছাড়া ক্যাম্পাস ছেড়ে বাসায় তেমন আসা হয় না। ক্যাম্পাসে থাকাকালে ক্লাস ছাড়াও খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করা হয়। যে কারণে ব্যস্ততার মধ্যেই সময় কেটে যেত। কিন্তু এখন এমন একটা সময়ের সম্মুখীন আমরা, যেখানে ঘরে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
তবে এভাবে কাজ ছাড়া বসে থাকা খুব বিরক্তিকর। নিজেকে সব সময় কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পছন্দ করি। যেহেতু অনলাইন ক্লাসের ঝামেলা নেই, তাই প্রথমদিকে অনলাইন পোর্টালগুলোর সাহিত্যবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। পত্রিকায় লেখা পাঠাই। আমার কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটার পর একটা নেতিবাচক দিক লেগেই থাকে, এসব কারণে মন খারাপ হয়। প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় মানুষগুলোকে কাছে যাওয়ার অপেক্ষা দিন দিন মনটা অশান্ত করে তুলছে। করোনার এই সময়ে মন ভালো রাখতে হলে নিজেকে ব্যস্ত রাখাই এখন একমাত্র উপায়। আশায় আছি সেদিনের, যেদিন করোনানামক ভাইরাস থেকে মুক্তি পাব আমরা, নতুন উদ্যমে আবার পথচলা শুরু করব। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আগের মতো। আবার আমাদের বাঙালিয়ানা, আবেগ, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটুক। আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখরিত হোক প্রাণের ক্যাম্পাস—সেই প্রত্যাশায়।