এই মেয়েরা কি আর স্কুলে ফিরবে না

করোনার সময় নিভৃতে শুরু হয়েছে আরেক মহামারি—বাল্যবিবাহ। বিশ্বব্যাপী বহু পরিবারকে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিয়েছে করোনা, আমাদের দেশও ব্যতিক্রম ছিল না। আমাদের অনেক মা-বাবাও মনে করেছেন, সময়ের আগেই মেয়েকে বিয়ে দেওয়া ছাড়া সেই মুহূর্তে তাঁদের আর কোনো বিকল্প নেই। এভাবে বিবাহের শিকার হয়েছে কয়েক লাখ কিশোরী।

বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে দীর্ঘ কয়েক দশকের অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে করোনা। এ মহামারি লিঙ্গবৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। স্কুল বন্ধ, মা-বাবারা বেকার আর করোনার বিধিনিষেধে বেড়ে গিয়েছিল সহিংসতা ও ধর্ষণ। এসব কারণে মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে মা-বাবারা তাদের নাবালক বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বিয়ে হলে অন্তত মেয়েটির অন্ন–বস্ত্রের চিন্তা থেকে মুক্তি পান মা–বাবা। মেয়ের নিরাপত্তার জন্য সারাক্ষণ আর তটস্থ থাকতে হয় না।

বাল্যবিবাহ
অলংকরণ: আরাফাত করিম

পরিসংখ্যান বলছে, করোনার কারণে ২০২০ সালে কমপক্ষে পাঁচ লাখ অপরিণত বয়সী মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহর শিকার হতে পারে আরও ২৫ লাখ মেয়ে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এটাই বাল্যবিবাহের সর্বোচ্চ হার।

নারী উত্ত্যক্ততা, যৌন হয়রানি, নিরাপত্তার অভাব—এগুলোকেই বাল্যবিবাহের কারণ ধরা হয়। মেয়েকে যৌন হয়রানি থেকে বাঁচাতে বিয়ে দেওয়াটাকেই ভালো উপায় মনে করেন অভিভাবকেরা। সেই মনে করা থেকে বাল্যবিবাহের বলি হয় গ্রাম-চরাঞ্চলের কিশোরীরা।

বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে লাখ লাখ কিশোরী। অন্যদিকে স্কুল বন্ধ থাকায় এবং অর্থনৈতিক কারণে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে কিশোরেরাও। করোনায় চাকরি হারিয়েছেন অনেক কিশোর পরিবারের কর্তাব্যক্তি। পরিবারের ব্যয়ভার বহন করতে শিশুশ্রমের পথ বেছে নিচ্ছে বহু কিশোর। এই ঝরে পড়া শিশুরা কি ঝরে পড়া ফুলের মতোই হবে? তারা কি আর বিদ্যালয়ে ফিরতে পারবে না? তাদের বিদ্যালয়ে ফেরানোর উপায়টাই–বা কী? এই প্রশ্নগুলো করেছিলাম ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের পরিচালক (যোগাযোগ ও অ্যাডভোকেসি) টনি মাইকেল গোমেজের কাছে। তিনি জানান, ‘প্রতিবছর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগে প্রায় ১৭ শতাংশ ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষের আগে প্রায় ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এর পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিবাহ। বিশেষ করে শহরের বস্তি, চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুরাই বেশি স্কুলের পথ ভুলতে থাকে। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সচেতনতার পাশাপাশি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

এ ছাড়া সরকারের একটা প্রণোদনা দেওয়া দরকার। শিক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে, সে ব্যাপারে সরকারকে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা বাজেটে যতটুকু বরাদ্দ আছে, তার সবটুকু বিদ্যালয়ের ব্যয়ভার বহনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জন্য খরচ করতে হবে। স্কুল থেকে আর্থিক সুযোগপ্রাপ্তি, সুযোগ-সুবিধা পেলে আসলে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম কমে যায়।

ঝরে পড়া শিশুদের কীভাবে আবার স্কুলে ফেরানো যায়, এ বিষয়ে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের সিনিয়র ম্যানেজার (অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড ক্যাম্পেইন) সামিয়া আহমেদ বলেন, ‘করোনায় চাকরি-কাজ হারিয়ে অনেক পরিবার দরিদ্র হয়ে গেছে। এই পরিবারগুলো আর্থিক সংকটের কারণে মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিয়েছে আর ছেলেদের শিশুশ্রমে নিযুক্ত করেছে। এখন এই শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে আমাদের দ্বিগুণ শ্রম দিতে হবে। সরকারকে এ জায়গায় আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।

বৃত্তি দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের আয়-উপার্জনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রাখা দরকার। এ ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক কিছু কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন কার্যক্রমগুলো ব্যাপকভাবে নেওয়া গেলে শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে যুক্ত হওয়ার পরিবর্তে বাড়িতেই মা-বাবাকে সাহায্য করতে পারে। মা-বাবার কাছে শিশুকে তখন বোঝা মনে হবে না। অভিভাবকদের উপার্জনের পথ অবশ্যই চালু রাখতে হবে। আর যেসব কন্যাশিশুর বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে, যে এলাকায় তার বিয়ে হয়েছে, সেই এলাকার স্কুলে তাকে নিবন্ধন করতে হবে। শ্বশুরবাড়ির লোকদের বুঝিয়ে তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।’