এই যে! রং দিয়েছে প্রকৃতি

হাল ফ্যাশনের পোশাকে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রাকৃতিক রং। মডেল: সূচনা
হাল ফ্যাশনের পোশাকে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রাকৃতিক রং। মডেল: সূচনা

জ্যোছনার সাথে চন্দন দিয়ে
মাখাব তোমার গায়,
রামধনু হ’তে লাল রং ছানি’
আল্তা পরাব পায়।
(‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’ / কাজী নজরুল ইসলাম)

সালোয়ারের ধরনে থাকছে বৈচিত্র্য। মডেল: সামিয়া
সালোয়ারের ধরনে থাকছে বৈচিত্র্য। মডেল: সামিয়া

কবিরা আকাশের তারা এনে প্রিয়ার খোঁপায় পরাতে চান। কাব্য করে বলেন, আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল। কিন্তু প্রকৃতি থেকে উপমা ধার করে ঠিক কী রঙের পোশাক চাই, তা কি আপনি-আমিও বলি না! বলি না, পেঁয়াজের খোসার যে নরম রং, সেটা কি পাওয়া যাবে? কৃষ্ণচূড়ার টকটকে লালটাই যে পছন্দ, আর কোনো লালে চলবে না। কাঁচা হলুদের যে উজ্জ্বলতা, তার তুলনা আর কোন রঙে? প্রকৃতির রংগুলোই চাই পোশাকেও? পাবেন। ‘মেহেদির মতো চাপা খয়েরি’ বলে রং বোঝাতে হবে না। একদম মেহেদি থেকে তৈরি সেই রংটাই পেয়ে যাবেন।

পোশাক: অরণ্য সাজ: পারসোনা ছবি: কবির হোসেন
পোশাক: অরণ্য সাজ: পারসোনা ছবি: কবির হোসেন

খয়েরি রংটা যে খয়ের থেকে এসেছে, এটা হয়তো সব সময় মনেও থাকে না । তা থেকেই বোঝা যায়, প্রাকৃতিক রঙে রাঙানো পোশাকের চল আমাদের দেশে অনেক দিন ধরেই। কিন্তু আজকাল প্রাকৃতিক রং বা ন্যাচারাল ডাই হয়ে উঠেছে চলতি কেতা। বেশ কিছু ফ্যাশন হাউস কাজ করছে এ নিয়ে। আর পোশাকে প্রাকৃতিক রংটা তুলে আনার পাশাপাশি কীভাবে পোশাকটা একদম হালের চল অনুযায়ী উপস্থাপন করা যায় তা নিয়েও ভাবনা চলছে। শাড়ি আর গজ কাপড়ের পাশাপাশি তাই এখন স্কার্ট, স্কার্ফ, নানা কায়দার টপ, প্যান্ট কাটের সালোয়ার, ধুতি এসবও পাবেন। এমনকি গয়না আর ব্যাগেও ব্যবহার করা হচ্ছে প্রাকৃতিক রং।
আমাদের দেশে প্রাকৃতিক রং নিয়ে কাজের কথা বললে রুবী গজনবী আর তাঁর প্রতিষ্ঠা করা ফ্যাশন হাউস অরণ্যর কথা আগে আসবে। মূলত প্রাকৃতিক রং নিয়েই কাজ করে তারা। ১৯৯০ সালে অরণ্যর যাত্রা শুরু। নির্দিষ্ট একটি ধারায় কাজ করে এত দিন ধরে ফ্যাশন হাউস চালানোর উদাহরণ দেশে কমই আছে। কারুশিল্পের প্রতি নিজের আগ্রহ তো ছিলই, ১৯৭৯ সালে কারুশিল্প বিষয়ক এক কর্মশালায় ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম সৈনিক কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হওয়াটাও তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে বলে জানালেন রুবী গজনবী।
এরপর আশির দশকের শুরুতে বিসিকের উদ্যোগেই বাংলাদেশে এ নিয়ে কাজ শুরু হয়। আড়ং, কুমুদিনী—এই ফ্যাশন হাউসগুলোও প্রাকৃতিক রং নিয়ে কাজ শুরু করে। এখন দেশি উপকরণ নিয়ে কাজ করে এ ধরনের বড় সব ফ্যাশন হাউসেই কিছু না কিছু কাজ থাকে প্রাকৃতিক রং নিয়ে। দেশাল, যাত্রা, বনজ—এই ফ্যাশন হাউসগুলোর নিয়মিত আয়োজনেই থাকে এ ধরনের পোশাক।
প্রাকৃতিক উপাদান থেকে রং তৈরির প্রক্রিয়াটাও বেশ মজার। এ বছর রোজার ঈদের আগে সুযোগ হয়েছিল ফ্যাশন হাউস অরণ্যর কারখানা ঘুরে দেখার। স্পায় ঢুকলে নানা রকম ভেষজ উপাদানের গন্ধে একটা বেশ শান্তির অনুভূতি আসে—প্রাকৃতিক রঙের কারখানাও যেন কিছুটা এমন; রং করে ধুয়ে দেওয়া কাপড় থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ পাওয়া যায়। হরীতকী, খয়ের, মেহেদি, নীল—এসব উপাদানের মিশ্র গন্ধটায় বুক ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে। এ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে রুবী গজনবীর লেখা রঙিন: ন্যাচারাল ডাইস অব বাংলাদেশ বইটি দেখতে পারেন। অরণ্যর শাখাগুলোতে কিনতে পাওয়া যাবে।
শৌখিন মানুেষর ক্লজেটে অনেক আগে থেকেই জায়গা করে নিয়েছে প্রাকৃতিক রঙে তৈরি পোশাক—জামদানি, সিল্ক বা মসলিনের পাশাপাশি একটা বা দুটো প্রাকৃতিক রঙে রাঙানো শাড়ি থাকেই। বাংলাদেশে তৈরি প্রাকৃতিক রঙের পোশাকের চাহিদা বিদেশি ক্রেতাদের কাছেও প্রচুর। টি–শার্ট, ঢিলে পায়জামা আর গলায় প্রাকৃতিক রঙের স্টোল—এমন পোশাক পরা ভিনদেশি তরুণ, কিংবা চমৎকার র্যা প স্কার্ট আর কুর্তা পরা বিদেশিনীর দেখা পেয়ে যাবেন ঢাকার রাস্তাতেই। তবে এ সময়ের তরুণ-তরুণীদের কাছে প্রাকৃতিক রঙের পোশাকের চাহিদা কেমন? কথা হলো ফোয়ারা ফেরদৌসের সঙ্গে। পটের বিবি নামে অনলাইন ফ্যাশন হাউস আছে তাঁর। তাঁর ফেসবুক পেজে প্রাকৃতিক রঙের শাড়ি আর ব্লাউজ পিস আছে। ঈদের সময়ে কুর্তাও করেছিলেন। ‘চাহিদা বেশ, ঈদের সময়ে সব ক্রেতাকে দিতেও সারতে পারিনি। শাড়ি আনলেই বুকড হয়ে যায়। আমি নিজেও পরতে খুব পছন্দ করি। বেশ একটা আভিজাত্য আছে প্রাকৃতিক রঙে তৈরি পোশাকের। পরতেও আরাম।’ বললেন তিনি।

.
.

শিবোরি, টাইডাই ইত্যাদি নকশার কাজ হচ্ছে প্রাকৃতিক রঙের পোশাকে। কাঠের বোতাম, কড়ি, লেস, এমব্রয়ডারি যোগ করেও ভিন্নতা আনা হচ্ছে। তবে ফোয়ারার কথা ধরে বলা যায়, খুব ঝলমলে কোনো কিছু মানায় না এমন পোশাকে। চকমকে চুমকি, পাথরের কাজ এতে থাকবে না। এর সাদামাটা আভিজাত্যই একে অনন্য করেছে। রোজকার কাজে বেরোনোর সময় প্রাকৃতিক রঙের সাদামাটা কুর্তা আর জিনস পরে যেমন বেরোতে পারেন, আবার জমকালো কোনো দাওয়াতে সবার নজর কাড়তেও সিল্ক বা অ্যান্ডি কাপড়ের ওপর প্রাকৃতিক রঙে রাঙানো শাড়িই যথেষ্ট।
পরিবেশবান্ধব যেকোনো মানুষই উৎসাহী হবেন এ রঙের পোশাক ব্যবহারে। একটি সাধারণ টি–শার্টে কৃত্রিম রং বসাতে ব্যবহার করতে হয় ১৬ থেকে ২০ লিটার পানি। ৮০ শতাংশ রং যায় কাপড়ে। বাকিটা বর্জ্য হিসেবে ফেলা হয়, সেটা কিন্তু ছড়িয়ে যায় আমাদের পরিবেশেই। এ তথ্য প্রকাশ করেছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৬ সালে ওয়েল ড্রেসড শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে এটি জানানো হয়। রাসায়নিক রঙের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা ভাবলে প্রাকৃতিক রংকে চমৎকার বিকল্প হিসেবেই দেখা যায়। অবশ্য বাংলাদেশের ফ্যাশন বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, রাসায়নিক রঙের বদলে পুরোপুরিভাবে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার এখনই সম্ভব নয়, উৎপাদনের স্বল্পতার কারণে। তবে এর ব্যবহার বাড়াতে দোষ কী!