এইবার মা আমাকে বেশি ভালোবাসবে!

টগবগে তরুণ, সদা হাস্য, সদা তৎপর। কিন্তু চিকিৎসকের পরীক্ষায় জানা গেল শরীরে বাসা বেঁধেছে তাঁর কর্কট রোগ! আকাশ ভেঙে পড়ল মা-বাবার মাথায়। আর সদা হাস্য তরুণ তখন যদি বলেন, এইবার মা আমাকে বেশি ভালোবাসবে! তখন মায়ের কেমন লাগে?

ফ্ল্যাশব্যাকে যাই। এই ছেলে যখন গর্ভে, বাংলাদেশের নামকরা অর্থনীতিবিদ মা প্রতিমা পাল মজুমদার তখন পোল্যান্ডে পিএইচডি গবেষণারত। ভারসাভা শহরের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে হবু মা দুচোখ ভরে দেখতেন শীতের শেষে বসন্তের আগমন। ফুসফুস ভরে নিতেন প্রকৃতির মিষ্টি গন্ধ। সমস্ত শরীরে যখন ছড়িয়ে পড়ত সুখানুভূতি। তিনি বেশ বুঝতেন তাঁর সন্তানও নড়েচড়ে উঠছে। দেশে থাকলে যে আদর-যত্ন পেতেন, বিদেশে সতীর্থরা তা পুষিয়ে দিতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি। ভালো খাবার, সুন্দর জায়গায় বেড়ানো, সিনেমা-থিয়েটার-অপেরায় নিয়ে যাওয়া, বাদ রাখেনি কিছুই। বিখ্যাত রাশিয়ান ব্যালে সোয়ান লেকও দেখা হয়েছে এই সময় গর্ভের সন্তানকে নিয়ে। প্রতিমা পাল মজুমদারের স্বামী চেয়েছেন তাঁর সন্তান জন্ম নিক নিজের দেশে। তাই নানা অনুমতি নিয়ে স্বামী-স্ত্রী ফিরছিলেন দেশে। কিন্তু যাত্রাবিরতিতে মায়ের শরীর খারাপ হওয়ায় কলকাতার ক্লিনিকে জন্ম নিল অনিন্দ্য মজুমদার। মা-বাবার আদরের বাপ্পু। দেশে ফিরে ছেলের আট মাস বয়স পর্যন্ত মা ছিলেন তার কাছে। তারপর থিসিস শেষ করতে চলে যান পোল্যান্ড। ইচ্ছে, আগেভাগে কাজ শেষ করে ছেলের কাছে ফিরবেন। বাপ্পু রইল ঠাকুরমা, মাসি, বাবার কাছে। ঠিক এই জায়গাতেই ব্যথারে মোর মধুর করি বইয়ের লেখক প্রতিমা পাল মজুমদার আত্মগ্লানিতে পুড়ছেন। লিখছেন, ‘পরবর্তী সময়ে বুঝতে পেরেছি আমার এই সিদ্ধান্ত কত বড় ভুল ছিল.... কারণ, পরে জেনেছি একটি শিশুর বেড়ে ওঠার তিন বছর অবধি সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ পোল্যান্ডে প্রচণ্ড ঠান্ডার ভয়ে বাপ্পুকে সেখানে নিয়ে যাননি। বাপ্পুর যত্নের ত্রুটি হয়নি, কিন্তু মায়ের তুলনা যে মা-ই, এ কথা ভেবে বারবার নিজেকে দোষারোপ করেছেন লেখক। ছেলের দুই বছর বয়সে একবার দেশে এসেছিলেন মা। ছেলে তখন মাসিকে মা ডাকে। খেলনার লোভে খানিকক্ষণ কাছে থাকলেও মা ডাকেনি ছেলে। ছেলের তিন বছর বয়সে বাবার সঙ্গে পোল্যান্ড যায় ছেলে, পাবলিক মিটিংয়ে মায়ের থিসিস ডিফেন্ড অনুষ্ঠানে। মা প্রাণপণ চেষ্টা করেন ছেলের সঙ্গে সখ্য তৈরি করতে, ফারাক থেকেই যাচ্ছিল। তাই মা মনে করেন নিজের পিএইচডির ‘উচ্চাভিলাষে’ সন্তানের মনে বঞ্চনা বোধের জন্ম হয়েছে। এই বৈষম্যবোধ তার রোগ প্রতিহত করার শক্তি দুর্বল করায় সে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। এমনকি ছোট ভাইয়ের জন্মের পর চোখের সামনে যখন দেখত মা ছোট ভাইকে দুধ খাওয়াচ্ছে, আদর করছে, বাপ্পুর মনে হতো মা ছোট ভাইকে বেশি আদর করে। এসব কারণেই হয়তো দেশের একজন নামকরা কর্মজীবী নারী একজন অর্থনীতিবিদ লিখছেন—কাজের জন্য দেশের বাইরে অবস্থান করা এবং শিশুসন্তানের পালনের মধ্যে একটি সুসমন্বয় খুঁজে বের করতে হবে কর্মজীবী মায়েদের।

অথচ পরবর্তীকালে মেধাবী চৌকস ছেলেটি গর্ববোধ করত মায়ের কর্মজীবন নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রধান বিষয় অর্থনীতি নিয়েই পড়েছিল অনিন্দ্য। আবার আনুষঙ্গিক বিষয়ের মধ্যে ছিল মহাকবি কালীদাসের রচনাবলি। ২৭ বছরে হয়েছিল একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক। মায়ের সঙ্গে দেশের উৎপাদন খাত নিয়ে নিজস্ব চিন্তার আদান-প্রদান চলত অহরহ। মা লিখেছেন, ‘ইউপিএল (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড) থেকে প্রকাশিত এনজেন্ডারিং গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ: দ্য বাংলাদেশ কনটেক্সট শীর্ষক আমার বইটাও বহুলাংশে আমার জ্যেষ্ঠপুত্রের মন্তব্য বিবেচনায় নিয়ে রচিত হয়েছে।... সে আমার উৎসাহদাতাও ছিল। কত সময় মনে হয়েছে চাকরি ছেড়ে দিই, গবেষণা ছেড়ে দিই এবং পুরোদমে ঘর-সংসার করি। কিন্তু আমার জ্যেষ্ঠপুত্র তা করতে দেয়নি।’ মা একই সঙ্গে গবেষণা এবং সংসারের কাজে পারদর্শী বলে ছেলের অহংকারও ছিল। বই থেকে জানা যায়, ২০০৬ সালের ২৬ মে প্রথম আলোর উদ্যোগে একটি গোলটেবিল আয়োজিত হয়। বিষয় ‘পোশাকশিল্পের সমস্যা ও সমাধান’। প্রতিমা পালকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ছেলে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। মা তাকে ঘিরে সারাক্ষণ, ভারাক্রান্ত মন। তাই প্রথমে অপারগতা জানান। কিন্তু ছেলেই তাঁকে জোর করে এই বৈঠকে পাঠায়। শুধু তা-ই নয়, বৈঠকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য তথ্য-তত্ত্ব দিয়ে মাকে সহযোগিতা করে।

মাকে প্রচণ্ড ভালোবাসত ছেলে। প্রশংসাও করত। তবে ধরনটা অন্য রকম। লেজার প্রিন্টার থেকে বের হওয়া প্রথম প্রিন্ট ছিল মাকে লেখা একটা চিঠি। মজা করে বলত, ‘লক্ষ করেছি বাবার বন্ধুদের বউদের মধ্যে আমার বাবার বউ হচ্ছে সব চাইতে সুন্দরী।’ রান্না করতে ভালোবাসেন প্রতিমা পাল। ছেলের ভালো লাগা ধরে রাখতে নতুন নতুন রেসিপি সংগ্রহ করে রান্না করতেন। তর্কবাগীশ ছেলের সঙ্গে নানা বিষয়ে তর্ক হতো মায়ের। ছেলের চিন্তাধারা, গুণে মুগ্ধ ছিলেন মা। আড়ালে বন্ধু-সহকর্মীদের সঙ্গে ছেলেকে নিয়ে কত যে গল্প করতেন! তবে সামনাসামনি প্রশংসা করতেন না। ভুলত্রুটিগুলো তুলে ধরতেন। তাই ছেলের অভিযোগ ছিল যে মা তার কোনো কাজের প্রশংসা করেন না, কেবল ভুল ধরেন। আজ ৩১ বছরের সেই টগবগে ছেলেটিকে হারিয়ে মা তাঁর লেখা বইয়ে অকপটে লিখছেন, ‘আমি মনে করেছিলাম ওর ভুলত্রুটিগুলো তুলে ধরলে ওর মধ্যে আরও ভালো কিছু করার জেদ চেপে যাবে আর এই জেদ তার উন্নতির জন্য একটি ড্রাইভিং ফোর্স হবে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, নিন্দার চাইতে প্রশংসাই বোধ হয় বাচ্চাদের মধ্যে ভালো কিছু করার জেদ উসকে দেওয়ার জন্য বেশি শক্তিশালী।’ প্রতিমা পাল মজুমদারের সহকর্মী অর্থনীতিবিদ রুশীদান ইসলাম রহমানের একটি কবিতা ছাপা হয়েছে এই বইয়ে।

অনিন্দ্য

কোথায় তুমি ছেলে?

মাকে এখানে ফেলে

জিতবেই করছো পণ লুকোচুরি খেলে!

জানো কি তুমি, মা যে কেবল কাঁদে?

সে বোঝে না, লুকোচুরিতে ছেলে

জিতে গেলে

কাঁদতে নেই।

তুমি একবার সশব্দে ‘কু’ করে বলো মাকে—তুমি আছো একটু দূরেই, পথের অন্য বাঁকে...

অথচ মা লিখছেন, ‘আজও যেন আমি সেভাবে কাঁদতে পারছি না।...আমি কাঁদব। আমার সমস্ত বুক নিংড়ে আমি আমার জ্যেষ্ঠপুত্রের জন্য কাঁদব। আছড়ে পড়ে আমি কাঁদব।...সেই দিন থেকে আমি কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, যার কোলে মাথা রেখে আমি চিৎকার করে কাঁদতে পারব আমার সমস্ত অন্তর ভরে, আমার শরীরের প্রতিটি অণু কাঁপিয়ে।’

বাপ্পু তার ছোট ভাই সুনন্দ মজুমদার টাপ্পুকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। মাকে অভয় দিত, ‘মা, তুমি চিন্তা কোরো না, আমি সব সময় ওর পাশে থাকব, ওকে দেখব।’ কিন্তু মা তার চাইতে তার ছোট ভাইকে বেশি ভালোবাসে, এই বিশ্বাস সব সময় মনে পুষে রাখত। অথচ দেশপ্রেমিক এই ছেলেটাকে শত চেষ্টা করেও আমেরিকায় স্থিত করতে পারেননি। ছেলে মা-বাবাকে সরাসরি প্রশ্ন করত ছোটবেলা থেকে এক রকম শিক্ষা দিয়ে আজ তবে কেন সংখ্যালঘুর দোহাই দিয়ে তাকে আমেরিকায় থাকতে বলা হচ্ছে? যায়নি সে। এমনকি ক্যানসারের উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে বারবার যাওয়া নিয়ে আফসোস করত, যদি চিকিৎসাটা দেশেই হতো! কেমোথেরাপি দেওয়ার পর সে এক দিনও সিঙ্গাপুরে থাকতে চাইত না। ১৯৭৫ সালের ২৪ জুন বাপ্পুর জন্ম। আর ২০০৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু বাপ্পুর বন্ধুরা মনে রাখতে চায় জন্মদিনটা। ২০০৮ সালের ২৪ জুন তাদের সহযোগিতায় ছোট ভাই সুনন্দ পারিবারিক উদ্যোগে প্রকাশ করে অনিন্দ্যকে নিয়ে একটি বই এ স্মল বুক অন এ লার্জ লাইফ। ৫১ জন লেখক। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা লিখেছেন। সেই বইয়ে মায়ের যে লেখাটি ছিল, সেটাই বিস্তারিত হয়ে নতুন আরেকটি বই ব্যথারে মোর মধুর করি। ২০১৬ সালের জুন মাসে প্রকাশ। বইটি এক মলাটে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই প্রকাশিত। বড় সন্তানের জন্ম থেকে শুরু করে শিক্ষা, কর্মজীবন, পরিবার, প্রেম, দেশপ্রেম, ক্যানসারের পরপর চারবার আক্রমণ, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া এবং শেষমেশ মায়ের উপলব্ধি—আমার জ্যেষ্ঠপুত্র আমার সঙ্গেই আছে, এ রকম নানা ভাগে লেখা। আছে নানা বয়সের নানা সময়ের ছবি। ছোটবেলার জন্মদিন থেকে শেষ জন্মদিন। ছেলের কষ্ট থেকে ছেলের স্বপ্ন।

>‘আজও যেন আমি সেভাবে কাঁদতে পারছি না।...আমি কাঁদব। আমার সমস্ত বুক নিংড়ে আমি আমার জ্যেষ্ঠপুত্রের জন্য কাঁদব। আছড়ে পড়ে আমি কাঁদব।...সেই দিন থেকে আমি কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, যার কোলে মাথা রেখে আমি চিৎকার করে কাঁদতে পারব আমার সমস্ত অন্তর ভরে, আমার শরীরের প্রতিটি অণু কাঁপিয়ে।’

সূচনায় লেখক প্রতিমা পাল বলেছেন, বইটি তাঁর বড় সন্তানকে নিয়ে লেখা হলেও চাকরি করা, মা হওয়া, সংসার করা, সন্তান লালন-পালন করা, এই বহুমাত্রিক কাজ করতে গিয়ে মেয়েরা যে দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়, সেই দ্বন্দ্ব তুলে ধরাও তাঁর লেখার উদ্দেশ্য। আর তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতায় বিষয়টি দেখা।

যার যায় সেই জানে কী যায়। শৈশবে মাকে কাছে না-পাওয়া ছেলেটির মনে ছিল কষ্ট, সেই ছেলেই ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার আগে মাকে নিয়েই গর্ব করে, মায়ের কাজকে সম্মান করে, দেশের অর্থনীতিতে কর্মজীবী মায়েদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নিজের স্বপ্ন বোনে। তাই হয়তো লেখক তাঁর লেখার শেষ অনুচ্ছেদে লেখেন—ভাবছি একটা ওম্যান্স ব্যাংক স্থাপনের জন্য জনমত গড়ে তুলতে তৎপর হব, যা কি না বাপ্পুর স্বপ্ন ছিল!