একটি আদর্শ প্রোফাইল পিকচারের খোঁজে

.
.

দিনে দুবার করে প্রোফাইল পিকচার পাল্টাত মেয়েটা। তোমার এটা একটা বাতিক, আমি বকতাম। মেয়েটা হাসত, কিংবা একটা স্ট্যাটাসই দিয়ে দিত হয়তো, ‘ফিলিং এংরি।’ এই শহরে লোকদের কোনো কাজ নেই নাকি। ফালতু কথাতেও শত শত লাইক দিতে হয়। আমিও লাইক দিতাম, যদিও কাজের অভাব নেই আমার মোটেও। ভার্সিটির ক্লাস, আবৃত্তি সংগঠন, টিউশন, পড়াশোনা। এসব করে আবার ফেসবুকিং! আমার একটাই অ্যাকাউন্ট, একটাই বন্ধু। পাগলামি প্রশ্রয় না দিয়ে উপায় কী!
বুড়িগঙ্গার ওপাশে কাশফুলে ছেয়ে ছিল পুরো শরৎ। শুভ্র কাশের মাঝে একটা সেলফি তুলেছিল মেয়েটা। চোখ বাঁকা করে সেলফি তুলতে তুলতে মেয়েিটকে ট্যারা লাগত মাঝে মাঝে। বলতেই ব্যাগটা ছুড়ে মেরেছিল আমার দিকে। আরেকবার বৃষ্টি নামছিল মেঘনার ওপর ট্রলারে। ছাতা মাথায় দিয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেল ফোনটাই। আশ্বিনের সেই বিকেলে আর প্রোফাইল পিকচার বদলানো হলো না। সেই কাশফুলের ছবিটাই রয়ে গেল। কী আশ্চর্য, আজও সেই ছবিটাই আছে।
আমার বাইকটাকে আমি পছন্দ করতাম, ও ভালোবাসত। বাইকে চেপে ছুটে বেড়াতাম হাইওয়েতে, হাইওয়ে পেরিয়ে মেঠোপথে, মেঠোপথ পেরিয়ে অজানায়। তেমনি এক অজানায় সেদিন বিকেলে আমরা দুজন। সেলফি স্ট্যান্ডে হাত দিয়ে মেয়েটা ছবি তুলছে একেকটা, আর বকছে আমাকে। হেলমেট পরে থাকলে ছবি তো পচা হয়ে যায়, নাকি? এই মেয়ে, আমি বাইক চালাচ্ছি, চুপ করে থাক, বলে শাসিয়ে দিই। তোমার হেলমেট নেই, ট্রাফিক আইনে এটা অপরাধ, জানো? খিলখিল করে হেসে ওঠে মেয়েটা। ১০ সেকেন্ডের অটো টাইমারে চাপ দিয়ে সেলফি স্টিকটা বাড়িয়ে দেয় সামনে। খোলা চুল পরির সামনে হেলমেট পরে নিজেকে এলিয়েন এলিয়েন লাগছে। ডানে একটা ট্রাক যাচ্ছে। পেছনে একটা বাস হর্ন দিচ্ছে। সরে জায়গা করে দেওয়ার আগেই সাঁ করে একটা ধাক্কা দিয়ে চলে গেল বাসটা। আর কিছু মনে নেই।
ঢাকার এক হাসপাতালে আইসিইউতে শুয়ে আছি। চিৎকার করে মেয়েটার কথা জানতে ইচ্ছে করছে, পারছি না। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, পারছি না। আমি দক্ষিণের সিনেমার নায়ক নই, সুপারম্যানও নই। আমি কার্জন হলের সামনে বাদাম খাওয়া, হলে থাকা মামুলি যুবক। বান্ধবীকে নিয়ে বাইকে চড়ে টান দিতে জানি শুধু। দিনে দুবার করে প্রোফাইল পিকচারে লাইক দিয়ে খুশি হয়ে যাই। অ্যাক্সিডেন্ট করে আইসিইউতে পড়ে থাকি। দুই দিন পর কেবিনে আসি, পকেটের টাকা তখন টানাটানিতে। বন্ধুরা মিথ্যা কথা বলে। মেয়েটা ভালো আছে। এই পায়ে একটু আঁচড় লেগেছে কি লাগেনি। হাঁটতে বারণ, তাই দেখা হবে না। পাঁচ দিন পর সত্য জানতে পাই। হাইওয়ে পুলিশ দুইটা বডি, একটা বাইক, আর দূরে ছিটকে পড়া স্ট্যান্ড সমেত একটা ফোন উদ্ধার করেছে। ছেলেটা তখনো বেঁচে আছে। মেয়েটা, আহ মেয়েটা...।
অনেক দিন পর আজ ছাদে উঠেছি। কৃষ্ণপক্ষের ঘুটঘুটে একটা রাত, একটা নিশুতি আকাশ, একটা প্রোফাইল পিকচার। মেয়েটা নিজেদের ছবি তুলতে গিয়ে আস্ত আকাশটাই বন্দী করে ফেলেছিল লেন্সে। প্রথম হেমন্তের নীল ঝকঝকে আকাশ। দুঃখ একটাই, আপলোড করার আগে নিজেই চলে গেল।
এর চেয়ে ভালো প্রোফাইল পিকচার আর কোথায়ইবা পেত মেয়েটা!
আহাদ আদনান
মাতুয়াইল, ঢাকা।