একুশে সংকলন নিয়ে কথা

উৎসাহ উদ্দীপনায়
চট্টগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধুরা নেমে পড়েন যুদ্ধে। এ যুদ্ধ অস্ত্র হাতে, এ যুদ্ধ কীভাবে অন্যান্য বন্ধুসভা থেকে নিজেদের একুশে সংকলনÈসন্তরণকে সেরা করে তুলবেন সেই যুদ্ধ!
এ যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব নেন চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সভাপতি মিনহাজ হোসাইন।
এরপর নির্ধারণ করা হয় রণক্ষেত্রের কলাকৌশল। সন্তরণের প্রকাশনা উপলক্ষে তৈরি করা হয় তিনটি কমিটি। এসব কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত বন্ধুরা উচ্ছ্বসিত হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে শুরু করেন তঁাদের দায়িত্ব পালন। আর যাঁরা দায়িত্ব পাননি, তঁাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছাপিয়ে যায় প্রকাশনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত বন্ধুদের উচ্ছ্বাসকেও।
কে, কীভাবে, কোন লেখা লিখবেন, কত দিনের মধ্যে লেখা জমা দিতে হবে, কোন কোন বিষয়ের ওপর লেখা জমা দিতে হবে, লেখা ছাপা হবে কি হবে না—এসব নিয়ে আলোচনা জমে ওঠে সব বন্ধুর মধ্যে।
মেতে ওঠে সন্তরণ নিয়ে আড্ডায়। এসবের মাঝেই চলতে থাকে তিনটি কমিটির কার্যক্রম।
বন্ধু সেঁজুতি গুপ্তার নেতৃত্বে বিজ্ঞাপন সংগ্রহে কাজ করে একটি দল। সঞ্জয় বিশ্বাসের নেতৃত্বে চলতে থাকে লেখা সংগ্রহ অভিযান।
অন্যদিকে সন্তরণের সম্পাদক আলমগীর রুমির নেতৃত্বে লেখা বাছাইয়ের কাজ করে একটি দল।
প্রতিদিন বন্ধুদের পদচারণে মুখর থাকে বন্ধুসভা কক্ষ। কীভাবে সন্তরণকে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, সমৃদ্ধ করা যায় বিভিন্ন লেখনীর মাধ্যমে, এসব নিয়ে বন্ধুরা পরামর্শ দেন সম্পাদককে। বন্ধুদের এমন উত্সাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে অবশেষে প্রকাশিত হয় আমাদের প্রিয় সন্তরণ।
শিহাব জিশান, চট্টগ্রাম
লেখার জন্য লড়াই
বলা সহজ, করা কঠিন—এই প্রবাদবাক্যটির নতুন চেহারা দেখলাম এবার। রাজশাহী বন্ধুসভা থেকে অমর একুশে সংকলন বের হচ্ছে। বন্ধুরা লিখছেন। বন্ধুসভার বাইরে থেকেও লিখছেন বিশিষ্ট লেখকেরা। এক দিনের মধ্যে লেখা দিয়েছেন বিশিষ্ট নাট্যকার মলয় ভৌমিক। চমত্কার লেখা। ভাষা তার অর্থ হারাচ্ছে, তাহলে কি আমরা রোজ অর্থহীন কথাবার্তা বলছি, নাকি অর্থহীন কাজকর্ম করছি! বেশ চিন্তার খোরাক দিয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রবাদবাক্যটির বোঝা এসে পড়েছে বন্ধুদের ঘাড়ে। ২০ দিন ধরে সন্ধ্যায় তাগাদা—কার লেখা কত দূর। সবাই বলে, এই হয়ে গেছে। আসলে হয় না। কবি নির্মলেন্দু গুভণের ভাষায়, ‘ফুটতে ফুটতে ফুটতে পারেনি বিয়ের ফুল আমার।’ শেষ পর্যন্ত কারও কারও ফুল ফুটল না। বুঝলাম, যারা পারে, প্রথম প্রহরেই পারে। তাদের ফুলেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সব আয়োজন শেষ হলো। সাজানো হলো রাজশাহী বন্ধুসভার একুশে সংকলন বরেন্দ্রবরণ। নামটির জন্য বৈঠক করতে করতে যখন দেখা গেল শুধু চায়ের বিল বাড়ছে, তখন বন্ধুসভার জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী সভাপতি তাঁর পছন্দের নামের প্রস্তাবটি পেশ করলেন। তখন রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার মন্ত্রীদের মতো সবাই বলে উঠলেন, আমারও ছিল মনে...। প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী সুব্রত দাস। বরেন্দ্রের মাটিতে কোথাও কোথাও এখন সবুজের সমারোহ, যদিও কোথাও কোথাও কাঁটাগাছ, লাল মাটি রয়েই গেছে। তবে তার মধ্যেও আবার ফুটছে রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, জারবারা—সব মিলিয়ে আমাদের লাল-সবুজের বাংলাদেশ। তার মধ্যে আমাদের এক টুকরো বরেন্দ্রভূমি।
ফারুক হোসেন, রাজশাহী
ব্রত হয়ে দাঁড়ায়
ভাষার মাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বন্ধুদের লেখালেখির উন্মাদনা। বরিশাল থেকে বের হবে একুশের সংকলন। এমন আহ্বানের পর পরই বন্ধুরা বসে যান সংকলনের নাম দেওয়া ও লেখা সংগ্রহের কাজে।
ভালো একটি প্রকাশনার জন্য চলে বৈঠকের পর বৈঠক। সবাই মিলেই ঠিক করেলন সংকলনের নাম।
একুশের সংকলনের নাম দেওয়া হয় প্রতিবিম্ব। নাম ঠিক হলো, এবার লেখার সন্ধানে ছোটাছুটি। নিজেদের লেখা থাকতেই হবে। তা না-হলে প্রকাশনার আনন্দ যে ফিকে হয়ে যাবে। তাই লেখার প্রতিযোগিতা শুরু হয় বন্ধুদের মধ্যে।
একদল ব্যস্ত হয়ে পড়ে লেখা সংগ্রহে। অন্যরা যে লেখা আসছে, তা নিয়েই ছুটছে প্রেসে। কম্পোজ করিয়ে প্রুফের দায়িত্ব নিলেন কেউ কেউ। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই বই বের করতে হবে, এ-ই যেন ব্রত হয়ে দাঁড়ায় বন্ধুদের।
এবারের পর্ব, আমরাই পারি নান্দনিকতাসমৃদ্ধ প্রকাশনা বের করতে। তারই প্রতিযোগিতা।
লেখা বিন্যাস ও প্রচ্ছদের ভাবনা দিলেন সহসভাপতি তন্ময় কুমার নাথ। বায়ান্নর শহীদ মিনারের ওপর শাণিত প্রতীক, যেন লাল-সবুজের একখণ্ড মানচিত্র।
প্রচ্ছদ শেষে বন্ধুদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় আরও। এবার কার লেখা আগে, আর কার পরে—এ নিয়েও বন্ধুদের মধ্যে বৈঠক। নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিলেন। Èআগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি...। তাই তো দুনিয়া-কাঁপানো ৩০ মিনিট প্রাধান্য পায়।
মাতৃভাষার ইতিহাসকে অনুপ্রাণিত করতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টা ২০ থেকে ৩টা ৫০ মিনিটের ইতিহাস তুলে ধরা হয় প্রথমে। এরপর একে একে অন্যদের লেখা ও কবিতা।
এবার একুশ উপলক্ষে বরিশালসহ সারা দেশের বন্ধুদের একটি জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। ৩০টির বেশি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ—এটা আমাদের নতুন করে আশা জাগায়।
ফারজানা আক্তার, বরিশাল
ইচ্ছেতলায়
অনেক দিন পর ফরিদপুর প্রথম আলো বন্ধুসভার উদ্যোগে ইচ্ছেতলা নামে আরেকটি সংকলন প্রকাশিত হলো। প্রকাশ করতে গিয়ে বুঝলাম, এ কাজটি যত সহজ ভেবেছিলাম, তত সহজ নয়। যদিও বা দফায় দফায় তাগাদা দিয়ে বন্ধুদের কিছু লেখা সংগ্রহ করা হলো, কিন্তু ছাপাখানায় যাওয়ার পর আমরা বুঝলাম সব সময় ছাপাখানার কম্পোজিটরের পাশে গ্যাট হয়ে বসে না থাকলে কাজ এগোয় না। সুযোগ পেলেই অন্য কাজে হাত দেওয়া,বাকিটা আমি ঠিক করে দেব—এ প্রতিশ্রুতিতে নিশ্চিন্তমনে বাড়ি ফিরে এলেও স্বস্তি নেই। কেননা, পরদিন ছাপাখানায় গিয়েই চক্ষু চড়কগাছ! বিন্দুমাত্র হাত পড়েনি লেখায়। গতকাল যেমনটি ছিল, আজও সে অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
তারপর প্রুফ দেখানোর জন্য কয়েক দফা এক শুভাকাঙ্ক্ষীর অফিস ও বাসায় দৌড়াদৌড়ি করা এবং শেষ পর্যন্ত কম্পিউটারের পর্দার সামনে তাঁকে টেনে আনা না হলে এ সংকলনটি আলোর মুখ দেখত কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ।
তার পরও গোলমালের শেষ ছিল না। ছাপানোর লিখিত ছাড়পত্র দেওয়ার পর বোঝা গেল সংকলনে প্রকাশকাল উল্লেখ করা হয়নি। সেটি সংযোজন করা হলো। এখানেই শেষ নয়। পরে আবার সংকলনটির ছোট একটি বিনিময়মূল্যও ধরে দেওয়া হলো, বলা যায় একেবারে শেষ মুহূর্তেই।
ইচ্ছে ছিল ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সংকলনটি হাতে পাওয়ার। কিন্তু প্রথমত, আমাদের কিছু উদাসীনতা ও পরবর্তী সময়ে প্রেসের কিছুটা দীর্ঘসূত্রতা আমাদের ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়।
তবে এত কসরত করে ফরিদপুর বন্ধুসভা শেষ পর্যন্ত কী বের করল তার বিচার করবেন মূলত পাঠক, অন্য বন্ধুসভার সদস্যরা।
সুজিত কুমার দাস, ফরিদপুর]
আহা, কী আনন্দ!
কেমন জানি এক অনুভূতি, সঙ্গে তীব্র উত্তেজনাও। শুধু আমার একার, তা কিন্তু নয়। রংপুর বন্ধুসভার সব বন্ধুর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে একই অনুভূতি আর উত্তেজনা। কারণ, একটাই—প্রকাশ হচ্ছে একুশের সংকলন বুলি।
এবারই প্রথম ভাষার মাসে একই সঙ্গে অনেক বন্ধুসভা একুশের সংকলন প্রকাশ করছে। এটি খুবই আনন্দের বিষয়। একসঙ্গে এত বন্ধুসভার প্রকাশনা অন্য কোথাও হয়েছে বলে জানা নেই। তাই তো সবার লক্ষ্য একটাই—আমাদের প্রকাশনার গুণ ও মান ভালো করতেই হবে। বন্ধুরা নেমে পড়ে প্রকাশনার কাজে।
একটা ভালো গল্প, কবিতা কিংবা অণুগল্প কীভাবে। বন্ধুসভার দপ্তরে একটি একটি করে অনেক লেখা জমা হয়। সব লেখা নিয়ে চলে আলোচনা। চলে সম্পাদনার কাজ। ৬৪ পাতার সংকলনে লেখা দিয়ে ভরাতে হবে। এটি চাট্টিখানি কথা নয়। দুশ্চিন্তায় পড়ে যান একুশের সংকলন বুলির সম্পাদক। ঠিক সময়ে লেখা আসবে তো? কেননা, বিশেষ প্রকাশনার শুরুতে সবার মধ্যেই ভীষণ আগ্রহ দেখা যায়। পরে দেখা যায়, লেখকদের পেছনে ছুটতে হচ্ছে। ভালো লেখেন যাঁরা, তাঁদের পেছনে তো আরও বেশি।
একুশের সংকলনের প্রচ্ছদ কেমন হবে, তা নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই। বই হাতে নিয়ে প্রথমে সবার দৃষ্টি-ই থাকবে প্রচ্ছদে। তাই এক-দুবার নয়, একাধিকবার প্রচ্ছদ-পরিকল্পনা হয়।
অবশেষে ভাষার মাসের প্রথম দিনই অর্থাৎ ১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচিত হলো। আহা, কী যে শান্তি! আহা, কী আনন্দ...।
সামীমা ইয়াসমিন, রংপুর
করচ
করচ হচ্ছে হাওরের গাছ। দুর্দান্ত গতিতে ছুটে আসা ঝড় আফালকে ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্য হাওরের মানুষ গ্রাম আর বাড়ির চারপাশে করচগাছ রোপণ করতেন। সব অপশক্তি মোকাবিলার প্রতীকী হিসেবেই এই ‘করচ’ নামকরণ। সব দুর্যোগ ঠেলে বাংলাদেশ আপন গতিতে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। সব অপশক্তি মোকাবিলার প্রত্যয়েই আমরা একেকজন সমাজে করচগাছ হয়ে উঠতে চাই।
করচ প্রকাশনাকালে ছোট কাগজটিকে আমরা সুন্দর, সুদৃশ্য, পরিচ্ছন্ন ও ঝকঝকে রাখতে চেয়েছি। দেশের কিছু প্রতিভাবান ও গুণী লেখকের লেখাও স্থান দিতে চেয়েছি। একটি সাহিত্য গুণমান-সমৃদ্ধ পত্রিকা তৈরির প্রচেষ্টা করেছি। এবার করচ কেবল রোপণ করেছি, এখনো সেটি চারা। তবে আমাদের পরিচর্যা ও যত্নে একসময় সেটি বৃক্ষ হয়ে উঠবে। আমরা বিশ্বাস করি,করচ বাংলাদেশে শুদ্ধ সাহিত্যচর্চার একটি অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। করচ আমাদের কাছে এক স্বপ্ন-বৃক্ষ।
তাপস তপু সরকার, সিলেট