ও কেন মা-বাবার উপর বিরক্ত হয়?

বন্ধুর সামনে সন্তানকে শাসন করলে সে বিরক্তই হয়। মডেল: আলভী, কনক খান ও কিরণ ছবি: কবির হোসেন
বন্ধুর সামনে সন্তানকে শাসন করলে সে বিরক্তই হয়। মডেল: আলভী, কনক খান ও কিরণ ছবি: কবির হোসেন

ধরা যাক ছেলেটির নাম শান্ত। বয়স ১৫ বছর। মা-বাবার অভিযোগ, শান্ত সব সময় তাঁদের ওপর বিরক্ত থাকে। শান্ত তাঁদের সামনে সব সময়ই যেন অশান্ত। যেকোনো কথাতেই চরম বিরক্তিভাব প্রকাশ করে। ঝাঁজিয়ে ওঠে, ঠিকমতো কথার উত্তর দিতে চায় না। শান্ত নিজেও স্বীকার করে, মা-বাবাকে তাঁর বিরক্ত লাগে। আবার এর জন্য সে মা-বাবাকেই দায়ী করে। সে বলে, তার বাবা-মা তার ওপর অতিরিক্ত নজরদারি করেন, কোচিং ক্লাসে, স্কুলে যেতে সব সময় তার মা-বাবা তাকে সঙ্গ দেন, কোচিংয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন, কখনো কোথাও একা ছাড়েন না। এসব নিয়ে সে বন্ধুদের কাছে হাসির পাত্র হয়। এ থেকেই তার বিরক্তি। মা-বাবার যুক্তি হচ্ছে, তাঁরা এসব করেন ছেলের নিরাপত্তার কথা ভেবে, ছেলে যাতে বিপথে না যায়।
ছোট শিশু থেকে শুরু করে বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরীরা নানা কারণে মা-বাবার ওপর বিরক্ত হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা সেই বিরক্তিভাব প্রকাশ করে। বিশেষ করে কোনো শিশু-কিশোরকে যদি একই বিষয় নিয়ে বারবার বলা হয়, তবে সে বিরক্ত হয়ে পড়ে। মা-বাবা হয়তো সন্তানের সার্বিক মঙ্গলের কথা ভেবেই একই বিষয়ে তাকে একাধিকবার সতর্ক করতে থাকেন। কিন্তু সন্তানের কাছে সেটি সব সময় গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। মা-বাবার প্রতি সন্তানের বিরক্ত হওয়ার ব্যাপারে তিন সন্তানের বাবা সরকারি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘সন্তানের কিছু আচরণ রয়েছে, যেগুলো তার নিজস্ব কিন্তু ক্ষতিকর, সেগুলো থেকে তাকে দূরে রাখতে চাইলেই তারা বিরক্ত হয়ে পড়ে। যেমন সন্তান চায় একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠতে আর আমরা চাইছি সে প্রতিদিন সকালে উঠুক। সন্তান চাইছে ফাস্টফুড খেতে আর মা-বাবা চান ঘরের খাবার খাওয়াতে। পছন্দের এসব আচরণ পাল্টাতে গেলে সন্তান বিরক্ত হয়।’ মিজানুর রহমান জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও নৈতিকতা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন হয় না। ভোগবাদী সমাজে সন্তানকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা করাতে গেলেও সে বিরক্ত হতে পারে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ওয়াজিউল আলম চৌধুরীর মতে, সন্তানের মনে বিরক্তি তৈরি না করে তার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত আচরণ পেতে হলে মা-বাবাকে সমন্বিত ও ছন্দোবদ্ধ আচরণ করতে হবে। সন্তানের কোনো বিষয়ে মা ও বাবার বড় ধরনের দ্বিমত পোষণ না করা ভালো। আবার সন্তানের কোনো অভ্যাস বা আচরণ নিয়ে তার সামনে একে অন্যকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। এতে সন্তান দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
নয় বছর বয়সী নিবিড়ের মা গৃহিণী শারমিন জাহান বলেন, ‘আমি কিছু নিষেধ করলে ও (নিবিড়) বিরক্ত হয়, রাগ করে; কিন্তু ওর বাবা যদি যখন একই কথা বলে, তখন সে রাগ না করে মন খারাপ করে, কান্না করে।’ তিনি জানান, টেলিভিশন দেখতে নিষেধ করলেই তাঁর সন্তান বিরক্ত হয়। ছেলের বিরক্তি কমাতে পরবর্তী সময়ে তিনি বাড়তি আদর করেন, কখনো বা পছন্দের কিছু কিনেও দেন।


অভিভাবকের করণীয়

: একে অন্যকে বুঝতে হবে: নিজের জায়গা থেকে সরে এসে অন্যের অবস্থানে নিজেকে কল্পনা করে করণীয় ঠিক করতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নিজের পছন্দ অন্যের ওপর চাপানোর চেষ্টা করবেন না।
: প্রশংসা করুন: সন্তানের ভালো দিকগুলোকে আরও পরিশীলিত করতে হলে তার প্রশংসা করুন।
: ধৈর্য: মা-বাবাকে ধৈর্য ধরতে হবে। সময় নিয়ে যেকোনো বিষয় ভেবে সিদ্ধান্ত দিন, হঠকারিতা করে অহেতুক রেগে যাবেন না। পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখুন।
: শাসন হবে গঠনমূলক: সন্তানের অভ্যাস ও আচরণের পরিবর্তন করতে চাইলে তাকে বিষয়টির ভালো ও মন্দ দিকগুলো বুঝিয়ে বলুন। সরাসরি বিরোধিতা না করে ভালো-মন্দ বিবেচনা করে সন্তানকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করুন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন কখনোই নয়।
: বিরক্তির চর্চা নয়: কোনো কারণে বাড়িতে বাবা-মা বেশি বেশি বিরক্ত হলে সন্তানেরা বিরক্ত হওয়া শেখে, তাই বাড়িতে বিরক্ত হওয়ার চর্চাটা বন্ধ করুন।
: প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ: অনেক সময় কিছু মানসিক সমস্যার (যেমন বিষণ্নতা, কন্ডাক্ট বা অপোনেন্ট ডিফিয়েন্ট ডিজঅর্ডার) কারণে সন্তানের মধ্যে বিরক্তিভাব দেখা দিতে পারে, তাই প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্য নিন।


সন্তানের বিরক্তির কারণ


একই বিষয় বারবার
একই বিষয় নিয়ে সন্তানকে প্রতিনিয়ত আদেশ-নিষেধ করে গেলে সে বিরক্তি বোধ করতে পারে।

সমালোচনা
আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও বাইরের মানুষের সামনে সন্তানের সমালোচনা করলে বা তার ত্রুটিগুলো নিয়ে কথ বললে।

ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিলে
অনেক সময় সন্তানের কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকে যেগুলো ক্ষতিকর নয়, কিন্তু বাবা-মা নিজেদের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে সন্তানের ইচ্ছাকে দমন করতে থাকলে সে বিরক্ত হতে পারে।

সন্দেহ
অকাট্য প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও সন্তানকে অহেতুক সন্দেহ করা।

নিরাপত্তা ও নজরদারি
শিশুর নিরাপত্তার কথা ভেবে তার ওপর অযৌক্তিক নজরদারি করলে বা সর্বত্র তাকে সঙ্গ দিলে, তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র অহেতুক ঘাঁটাঘাঁটি করলে সে বিরক্তি বোধ করে।

তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য
সন্তানকে সব সময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে, তাকে ব্যঙ্গ করলে বা তাকে নিয়ে সব সময় হাসাহাসি করলে।

তুলনা
অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে তাকে সব সময় আরেকজনের মতো হওয়ার জন্য বললে।

অভিযোগ
সন্তানের কোনো বিষয়ে স্কুলের শিক্ষক বা পরিবারের অন্য সদস্যের কাছে প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ করলে।

পছন্দের বিরোধিতা
সন্তানের পছন্দের কাজ (যেমন টিভিতে কার্টুন দেখা, কম্পিউটারে গেম খেলা) ও অভ্যাস—যেমন অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমানো, ফাস্টফুড খাওয়া ইত্যাদির সরাসরি বিরোধিতা করলে সে বিরক্ত হতে পারে।
লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ