তানিয়ার বয়স ১৩। পড়ছে ক্লাস এইটে। মায়ের সঙ্গে তার বোঝাপড়া ভালো ছিল। কিন্তু ইদানীং সে মায়ের কোনো কথাই মানতে চায় না। মা যা চান, তার কোনো কিছুই তার পছন্দ নয়। সবকিছুতে মায়ের বিরোধিতা। মা যা করতে বলবেন, তার উল্টোটা করাই যেন তার কাজ। তার ওপর সে প্রায়ই মায়ের সঙ্গে তর্ক করে, রাগ করে ধুমধাম দরজা বন্ধ করে দেয়। তানিয়াকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
বয়ঃসন্ধিকালে এ ধরনের আচরণের সমস্যা অনেক কিশোর-কিশোরীর মধ্যেই হতে পারে। তারা খানিকটা অবাধ্য হয়ে ওঠে। সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতির বিরোধিতা করাটাকে নিজের স্বকীয়তা আর স্বাধীনতা প্রকাশ করার মাধ্যম বলে মনে করে। এই বয়সের বেশির ভাগ মেয়ের সঙ্গে মায়ের সম্পর্কটা নিবিড় থাকে। ফলে যদি তাদের আচরণের কোনো সমস্যা তৈরি হয়, তখন সেটাও মায়ের সঙ্গে বেশি ঘটে। এই কিশোর-কিশোরী বয়সে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। আশপাশের সবকিছুকে তারা নতুন করে দেখতে শেখে। শরীরের পাশাপাশি তাদের মনঃসামাজিক পরিবর্তন শুরু হয়। এই পরিবর্তনের প্রভাবে এই বয়সী ছেলেমেয়েরা একধরনের সমস্যায় পড়ে। এ সমস্যার কারণে তাদের আচরণে প্রকাশ পেতে পারে অবাধ্যতা।
মেয়েদের ক্ষেত্রে মা এই অবাধ্য আচরণ সামলাতে হিমশিম খেয়ে যান, তিনি বিষয়টিকে অনেক সময় মেয়ের অপরাধ হিসেবে গণ্য করে তাকে ধমক দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করে, ধমক দিয়ে, ঘরে আটকে রেখে সমস্যাটির সমাধান করা যাবে না। বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরীদের অবাধ্য আচরণকে সামাল দিতে হলে অভিভাবক; বিশেষত মাকে হতে হবে সহনশীল, বুঝতে হবে নিজের সন্তানকে।

কী করবেন
নিয়ম তৈরি
পরিবারের সবার জন্য কিছু নিয়ম তৈরি করতে হবে। কেবল ছেলেমেয়েদের জন্য নয়, এই নিয়ম সবার জন্যই। সবাই নিয়ম মানতে থাকলে সন্তানের মধ্যে নিয়ম মানার অভ্যাস শিশুকাল থেকেই তৈরি হবে।
অবাধ্যতার দিকে মনোযোগ নয়
অবাধ্য আচরণকে বন্ধ করতে চাইলে সেই আচরণগুলোকে উপেক্ষা করতে হবে। এর ফলে সে প্রথম দিকে অবাধ্য আচরণ কিছুটা বাড়িয়ে দিলেও অপরের মনোযোগ না পাওয়ার কারণে অবাধ্য আচরণ করা কমাতে কমাতে বন্ধ করে দেবে।
স্বাভাবিক, ভালো আচরণকে উৎসাহ দেওয়া
স্বাভাবিক, ভালো আচরণকে প্রশংসা করতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে। এতে সে এই আচরণগুলো বাড়িয়ে দেবে।
উপেক্ষা, ব্যঙ্গ বা তুলনা নয়
‘উপেক্ষা’ একজন কিশোরীর আবেগের ওপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। ফলে কোনোক্রমেই তাকে উপেক্ষা করা যাবে না। কোনো পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তাকে ব্যঙ্গ করা বা অপর আরেকজন কিশোরীর সঙ্গে তাকে তুলনা করা চলবে না।
একই নির্দেশ বারবার নয়
কোনো একটি কাজ তাকে দিয়ে করাতে চাইলে বুঝিয়ে বলুন; তবে একই নির্দেশ তাকে বারবার দেবেন না। এতে তার বিরক্তি বাড়বে আর বারবার বলার কারণে একটা শর্তাধীন অবস্থা (কন্ডিশনিং) তৈরি হবে; তখন একবারে সে কোনো নির্দেশ মানতে চাইবে না।
অভিযোগ/বিচারপ্রার্থনা নয়
১৩-১৪ বছরের মেয়েটি এমন কিছু করেছে, যা আপনার পছন্দ নয়। সেটি নিয়ে ‘দেখো, তোমার মেয়ে কী করেছে’ ধরনের কথা বলে তার বাবার কাছে বিচার চাইতে পারবেন না। মা হিসেবে আপনিই সমাধানের চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে মেয়ের বাবার সঙ্গে আলোচনা করুন, কিন্তু সেই আলোচনা যেন বিচারপ্রার্থনায় পর্যবসিত না হয়।
ইতিবাচক ভঙ্গিতে কথা বলুন
‘স্কুলের ব্যাগ মাটিতে রাখবে না’, ‘রাত জেগে মোবাইল ফোনে কথা বলছ কেন’—এ ধরনের নির্দেশের চেয়ে বলতে পারেন ‘স্কুলের ব্যাগ টেবিলের পাশে রাখো’, ‘বন্ধুর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা সন্ধ্যার মধ্যে শেষ করো’ ইত্যাদি। এতে তার মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠবে।
গোপন নজরদারি নয়
এই বয়সের একটি মেয়ের ডায়েরি খুলে দেখা, তার মুঠোফোনের খুদে বার্তাগুলো গোপনে পড়া কখনোই ঠিক নয়। প্রয়োজনে আপনি তার সম্মতি নিয়ে দেখতে পারেন বা তার কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
আবেগীয় সম্পর্কের ব্যাখ্যা জানুন
বয়ঃসন্ধিকালের একজন মেয়ে একটি ছেলের সঙ্গে আবেগীয় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তেই পারে। বিষয়টির ব্যাখ্যা আপনার মেয়ের কাছ থেকেই জানার চেষ্টা করুন। তাকে বুঝিয়ে বলুন যে এই সময় তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে পড়ালেখা করা। রূঢ় আচরণ করে, মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে, স্কুল আর কোচিং বন্ধ করে, ঘরে আটকে রেখে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করুন, প্রয়োজনে একাধিকবার তার করণীয়গুলো বুঝিয়ে বলুন। ক্ষেত্রবিশেষে আপনার বিবেচনায় সীমিত পরিসরে তার সম্পর্কটিকে মেনেও নিতে পারেন।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন
অনেক সময় কিশোরী মেয়েটি জড়িয়ে যেতে পারে কোনো বিপদে। হঠকারী কোনো সিদ্ধান্তের ফলে যেকোনো ধরনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এমনকি ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেও ‘সাইবারবুলিং’সহ নানা বিপদে সে পড়তে পারে। এই বিষয়গুলো তাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলুন।
নিজের মনের যত্ন নিন
মায়ের নিজের মনেরও যত্নের প্রয়োজন। মেয়ের অবাধ্য আচরণে উত্তেজিত না হয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করুন। রাগ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে বড় করে শ্বাস নিন, এক মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করে চুপ থাকুন। ১০০ থেকে উল্টো দিকে মনে মনে গুনতে থাকুন, ঠান্ডা পানি পান করুন। পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আপনার মনের অনুভূতিগুলো মেয়ের সঙ্গে শেয়ার করুন। মেয়েসহ পরিবারের সঙ্গে আনন্দঘন সময় কাটান, বেড়াতে যান।
ঝুঁকিপূর্ণ আচরণকে সামাল দিন
প্রায়ই ঘুমের ওষুধ খাওয়া, হাত-পা কাটা, দেয়ালে মাথা ঠোকা, চুল ছেঁড়া, রাতের বেলায় রাগ করে বাসার বাইরে চলে যাওয়া, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন জিনিস ছুড়ে ফেলা, ভাঙচুর করা ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করতে থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
বয়ঃসন্ধিকালের অবাধ্যতাকে রাগ করে বা শক্তি প্রয়োগ করে সমাধান করা যাবে না। সহনশীলতা আর মেয়েকে বুঝতে পারার মধ্য দিয়েই অবাধ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা