ওপারেতে যত সুখ

আরেকটা ব্যর্থ ইন্টারভিউ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ফার্মগেটের মোড়ে। শেষ চৈত্রের বিকেলের রোদে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অসার লাগছে। কয়েকটা বাস এসেছিল। ভেতরে ওঠার যুদ্ধ করার মতো তাগিদ নেই। একটা ছোট মেয়ে, হাতে বেলি ফুলের মালা, অনেকক্ষণ ধরে ঘ্যান ঘ্যান করছে। ‘একটা মালা নেন স্যার, নেন না স্যার, দশ টাকা মাত্র দাম। দিই একটা?’ বকা দিতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু শক্তি নেই।

হঠাৎ চারদিক কালো হয়ে বাতাস এসে সব এলোমেলো করে দিল। লোকজন যেন দৌড়ে পালাতে শুরু করল। আমি তবু দাঁড়িয়ে। মালা হাতে মেয়েটাও দাঁড়িয়ে। ‘একটা মালা দিই, স্যার?’ তারপর এল সেই ঝড়। চৈত্র মাসে কম কালবৈশাখী হয়? মুহূর্তে পথ ফাঁকা। আমার চশমার লেন্স ঘোলা হয়ে গেছে। সনদে ভরা ফাইল ভিজে যাচ্ছে। মুঠোফোনে জল ঢুকে যাবে যেকোনো সময়। মেয়েটার মালাগুলো বেয়ে বেয়ে বৃষ্টির জল ঝরছে। চশমাটা খুলে ফেলি। অবাক তাকিয়ে দেখি রাস্তার ওপারে একটা মেয়ে একা দাঁড়িয়ে ভিজছে। ঠিক আমার মতো একা। দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে, আকাশের দিকে মুখ করে, বন্ধ দুই চোখে নবধারা জলে স্নান করছে। আমার কেন যেন মনে হলো, ওপারে ওই মেয়েটার সঙ্গে একসঙ্গে বৃষ্টিবিলাস না করলে এই জীবন বৃথা। আমার জড় শরীরে শক্তি ফিরে আসে। মালা হাতে মেয়েটার অবাক দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে আমি দৌড়ে যাই পদচারি-সেতুর দিকে। এদিকে বৃষ্টির বেগ কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি কমে গেলে মেয়েটা আবার জনসমুদ্রে মিশে যাবে। আমাকে এর আগেই যেতে হবে। মেয়েটার কাছে গিয়ে বলতে হবে, আমায় তোমার বৃষ্টি-সখা, করবে নাকি মেয়ে?

আমি যখন মেয়েটার খুব কাছাকাছি হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় একটা কালো গাড়ি। জানালা খুলে তাকায় এক যুবক। ‘সুমি, তোমার ফোন বন্ধ কেন? বৃষ্টিতে ভিজে তো কাক হয়ে গেছো। এসো, গাড়িতে ওঠো। ঠান্ডা লেগে যাবে তো জান।’

‘আমি যাব না। তোমাকে বলেছিলাম বেলি ফুলের মালা আনতে। এনেছ?’

বৃষ্টি থেমে গেছে। ওপারে বেলি ফুলের মালা হাতে মেয়েটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একটা ফুলও নিল না কেউ আজ বিকেলে। আমার সনদ সব ভিজে গেছে। মুঠোফোন নষ্ট হয়ে গেছে। আমি আবার মিশে গেছি জনসমুদ্রে। আমার না-বলা দুঃখগুলো বেলি ফুলের সৌরভ হয়ে চারদিক আচ্ছন্ন করে ফেলছে।