কণা বড় হতে চান

নিজের চায়ের দোকানে কণা। ছবি: সুমন ইউসুফ
নিজের চায়ের দোকানে কণা। ছবি: সুমন ইউসুফ

লেখা যেত, করুণা আক্তার কণা এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই বাক্যের মধ্যে আরও কয়েকটি শব্দ বসাতে হয়। আর তাহলে বাক্যটি হয়, প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি খুলে বলা যাক।

কণার বেড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকায়। একসময় ওই এলাকায় চা বিক্রি করতেন তিনি। এখন উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। অপেক্ষা করছেন স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্য।

তাঁর এই চা বিক্রির শুরু ছোটবেলা থেকে। আসলে তখন কতটা ছোট ছিলেন কণা? উত্তর শোনা যাক তাঁর মুখেই। ‘আমি যখন বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই দেখতাম মা আমাকে নিয়ে টিএসসিতে চা বিক্রি করেন।’ কণা জানালেন, ‘আরেকটু’ বড় হলে একাই সেই চায়ের দোকান চালাতেন। এর ফাঁকে করতেন পড়াশোনা।

কণা জানালেন, তাঁর পরিবারের কেউ আর পড়াশোনা করেননি। বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় ফেরি করে শাক-সবজি বিক্রি করতেন। মা করতেন চায়ের দোকান। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ি এলাকায় দোচালা টিনের ঘর করে ছিন্নমূল মানুষেরা যেখানে থাকত, সেখানটায় থাকত কণার পরিবার। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে কণা একাই পড়াশোনা করেছেন। সেটাও করতে হয়েছে নিজ তাগিদে।

‘আমার এক বন্ধুকে স্কুলে যেতে দেখতাম। ওকে দেখে আমিও মায়ের কাছে বায়না ধরলাম স্কুলে যাব।’ বলেন কণা। এভাবেই শুরু কণার পড়াশোনা। ভর্তি হন নীলক্ষেত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ভর্তি হন নীলক্ষেত হাইস্কুলে। এই বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পাস করেন ২০১১ এবং মাধ্যমিক পাস করেন ২০১৩ সালে। জানালেন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর অসুস্থতার কারণে মা আর দোকানে আসতেন না। ফলে দোকান একাই চালাতে হতো। তার মানে, কণা ‘আরেকটু’ বড় হন ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠে। কণা বলেন, ‘ওই সময় থেকে আমার ওপর চাপ বাড়ে। কারণ বাসা, নিজের পড়াশোনা, দোকান-সব একাই সামাল দিতে হতো। সঙ্গে অসুস্থ মায়ের সেবা-যত্ন করতে হতো।’ বিপত্তি এখানেই শেষ নয়; সহপাঠীদেরও খানিকটা টিপ্পনী শুনতে হয়েছে, তারা তাকিয়েছে বাঁকা চোখে। তবে এ নিয়ে কোনো খেদ নেই তাঁর। বলেন, ‘খারাপ লাগত যখন স্কুলের সহপাঠীরা টিএসসিতে আসত, তাকাত আমার দিকে। কিন্তু আমার এটা নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা ছিল না। কারণ আমি তো জানি আমার বাবার টাকা থাকলে আমি এই দোকান করতাম না। তার থেকে বড় কথা হলো, ব্যবসাটা আমার। আর এটা দিয়েই আমাদের চলতে হয়।’

কণা পড়াশোনা ছাড়েননি। কারণ, ‘আমি ক্যাম্পাসে সবাইকে দেখতাম পড়াশোনা করছে। আমি ভাবতাম, আমাকে পড়াশোনা করতে হবে, তাদের মতো হওয়ার জন্য।’ বলেন তিনি। জানালেন, কাজ করতে হতো বলে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে না পাড়ায় হোঁচট খেতে হয়েছে পড়াশোনায়ও। মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর তাঁর মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে বন্ধ রাখতে হয় পড়াশোনা। আবার উচ্চমাধ্যমিকে এসে ‘এক সাবজেক্টে ফেল করেন’। ‘তখন সবাই বলছিল, থাক বাদ দাও। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আবার পরীক্ষা দেই।’ বলেন কণা। জানালেন, ২০১৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন।

এর মধ্যেই নিজের সেই চায়ের দোকান গুছিয়ে নিয়েছেন। মেজ ভাই শাহাবুদ্দীনকে বসিয়েছেন সেই চায়ের দোকানে। তবে দোকানের নাম ‘কণা টি স্টল’ই আছে। মাঝেমধ্যে এখনো যান সেই দোকানে। কণার মা অসুস্থ, তাই গেল বছর স্নাতকে ভর্তি হতে পারেননি। ‘তবে এবার ভর্তি হব।’ বলেন কণা। কারণ পড়াশোনা করে কণা বড় হতে চান।