কবুতরের হাটে ঘুরতে ঘুরতেই একজনের খাঁচা থেকে ফুড়ুত্ করে একটা ঘিয়াসুল্লী কবুতর উড়ে গেল আকাশে। অথচ এতে সেই কবুতরওয়ালার চোখে-মুখে কোনো শঙ্কা নেই। শঙ্কার বদলে তাঁর চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক। একটু পরই আবার সেই ঘিয়াসুল্লী কবুতরটি ডানা মেলে উড়তে উড়তে ফিরে আসে দাউদ চৌধুরীর কাছে। বললেন, ‘দেখলেন, ক্যামনে পোষ মানাইছি এই ঘিয়াসুল্লীরে! অয় যেই হানেই যাউক না ক্যান, ফিইরা আইবই। এইটাই আমাগো শখ।’পুরান ঢাকার ঠাঁটারীবাজার। এখানেই বসে ঢাকার সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী কবুতরের হাট। বাজারটি বসে ফুটপাত ও ফুটপাতের নিচে। ফুটপাতের দুই পাশজুড়ে সবাই সবার কবুতরের খাঁচা নিয়ে বসে আছে ক্রেতার অপেক্ষায়। এখানকার সব বিক্রেতাই কম-বেশি সবার পরিচিত। ‘কবুতর বিক্রি করাটা আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। কার কী কবুতর আছে, কে কোন নতুন কবুতর এনেছে এটাই মূলত আমরা দেখি।’ কথাগুলো বলছিলেন এক কবুতরবিক্রেতা। তাঁর মতো এখানকার সব কবুতরবিক্রেতাই শৌখিন। এসব শৌখিন বিক্রেতা রংবাহারি আর বিচিত্র সব কবুতর নিয়ে বসেছেন এখানে। কবুতরের নামগুলোও ভারি সুন্দর। দেখতে কোনোটা ঠিক আমাদের দেশি কবুতরের মতো। আর বেশির ভাগ কবুতরই দেখতে পাকিস্তান, ভারত আর ইরানের কবুতরগুলোর মতো। তবে দেখতে বিদেশি হলেও কবুতরগুলো আমাদের দেশেই বেড়ে উঠেছে।কবুতরের হাটে ঢোকার মুখেই খাঁচার ওপর বসে আছে জগাপীর। আর খাঁচার পেছনে বসে বিক্রেতা সেই জগাপীরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ছোট্ট ঠোঁটের এই জগাপীর কবুতরের মাথায় একটা ছোট্ট ঝুঁটিও আছে। পাশেই ময়ূরের মতো পেখম মেলে নাচ দেখাচ্ছে লক্ষা। এই লক্ষা কবুতরের পেছনের পালকগুলো ময়ূরের মতোই মেলে দেওয়া। লক্ষা কবুতর মূলত পাকিস্তানি কবুতরের জাত। গাট্টাগোট্টা এক জোড়া লাক্ষা কবুতর বিক্রি হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকায়। বাগদাদি হোমা নামের কবুতরের গায়ের রং একদম সাদা। চোখে নকশাঅলা এই কবুতরের পেছনের পালক বেশ লম্বা। আশফাক হোসেন নামের এক বিক্রেতার খাঁচায় শীতের বালিহাঁসের মতো চুপচাপ বসে থাকা পাখিটি হচ্ছে ইস্টিচার কবুতর। লাল টকটকে পাওয়ালা এই ইস্টিচারের দামটাও বেশ। প্রতি জোড়া ইস্টিচার বিক্রি হয় আট হাজার টাকায়। পাশেই বসে ইতিউতি তাকাচ্ছে লম্বা লেজওয়ালা গোল্ডেন সুইট কবুতর। গায়ের রংটা ছাই আর বাদামি। এই গোল্ডেন সুইট কবুতরের প্রতি জোড়ার দাম চার হাজার টাকা। দামের বহর আর চেহারায় যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, এই কবুতরগুলো তেমন একটা উড়তে পারে না। এগুলো শুধু শখের বশেই মানুষ পোষ মানায়। আর পুরো হাটের মধ্যে ক্রেতাদের দৃষ্টি একবার করে যে কবুতরের ওপর পড়ছে, সেই কবুতরের নাম হলো গিরীবাজ। এই গিরীবাজ কবুতর হলো জালালি কবুতরের বংশধর। এই কবুতর অনেকক্ষণ আকাশে উড়তে পারে। আর গিরীবাজ কবুতর দিয়েই মূলত কবুতর ওড়ার প্রতিযোগিতা করা হয়। প্রতি জোড়া গিরীবাজ ৬০০ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।উড়ে যায় পারাবতকবুতরের হাটের বেশির ভাগ বিক্রেতাই বাজিকর। তাঁরা সারা বছর প্রশিক্ষণ দিয়ে শীতকালে কবুতর ওড়ার প্রতিযোগিতা করেন। কোনো একটা অচেনা জায়গা থেকে সবাই মিলে নিজেদের কবুতর আকাশে উড়িয়ে দিয়ে ঘরে ফেরেন তাঁরা। তারপর যার কবুতর সবার আগে বা যার সবচেয়ে বেশি কবুতর ফিরে আসে, সেই ব্যক্তিই বিজয়ী বলে বিবেচিত হন। তেমনই এক শৌখিন মানুষ হলেন আশফাক হোসেন। ২০০১ সালে এ রকম একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। সবাই ঢাকা থেকে দলেবলে নিজেদের কবুতর নিয়ে রওনা হয়েছিল গাজীপুরে। সবাই সবার কবুতর উড়িয়ে দিয়েছিল আকাশে। আশফাক হোসেন উড়িয়েছিলেন ৩০টি গিরীবাজ কবুতর। কবুতর উড়িয়ে দিয়েই তাঁরা আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর কার কবুতর আগে আসে এবং সবচেয়ে বেশি আসে, এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন তাঁরা। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা গড়িয়ে আসে। কিন্তু কারও কবুতরের কোনো খোঁজ নেই। হুট করেই সন্ধ্যার পর একসঙ্গে পাঁচটি গিরীবাজ কবুতর এসে পড়ে আশফাক হোসেনের মাথায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠেন অন্যরা। সবাইকে ডিঙিয়ে, সব বাধাকে উপেক্ষা করে আশফাক হোসেনের গিরীবাজ সেদিন জয় এনে দিয়েছিল তাঁকে। এভাবে কবুতর প্রতিযোগিতার জন্য শৌখিন মানুষজন দূর-দূরান্ত গিয়ে কবুতর ছেড়ে আসতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।১৯৯০ সালের পর স্থানীয় কিছু শৌখিন মানুষের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় এই কবুতরের হাট। আগে পরিসর অল্প ছিল, এখন তা অনেক গুণ বেড়ে গেছে। সপ্তাহে এক দিন করে প্রতি শুক্রবার সকালে বসে এই হাট। চেনা-অচেনা সবাই সেদিন মিলিত হয় একসঙ্গে। বেচাকেনা করে কবুতর। তারপর আবারও প্রস্তুতি নেয় আকাশে পায়রা ওড়ানোর, বাজিকর হয়ে ওঠার।