কবে যাব ফিরে

করোনাকালে প্রিয়জনদের কাছাকাছি আসার অপেক্ষা যেন আরও দীর্ঘ হচ্ছে প্রবাসীদের।
ছবি: অধুনা

মাধবীলতার গাছটা এখনো সেভাবেই আছে হয়তো। ঢাকায় আমাদের বাড়ির বারান্দার ঠিক পাশেই বিশাল একটা মাধবীলতার গাছ। ছোটবেলা থেকেই খেয়াল করেছি, আমার যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় হতো, তখন সেই গাছে চড়ুইপাখিগুলো খুব করে কিচিরমিচির শুরু করত। বাবার খুব প্রিয় জায়গা ছিল বারান্দায় সেই গাছের পাশে রাখা সোফাটা। আলোছায়া, ফুল আর পাখিদের সঙ্গে নিয়ে বাবা সেখানে বসে বই পড়তেন। আমি যখন পড়াশোনা করতে আমেরিকায় আসি, তখন আমাকে বিদায় দিতে সেই সব ফুল আর পাখির সঙ্গে বান্দায় দাঁড়িয়ে বাবা বলেছিলেন, ‘মা, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো, আর কখনো যদি দেখা না হয়।’ দেখা আমাদের হয়েছিল, কিন্তু আর কোনোদিন পাশে বসে গল্প করা হয়নি। বাবা নেই। এখন বারান্দার সেই জায়গা দখল করে বসে থাকেন মা। সারা বাড়িতে শুধু একজন মানুষ, সবগুলো রুমই এখন ফাঁকা। প্রতিদিন বিকেলে চড়ুইপাখির ডাকের সময় নিশ্চয় মনে পড়ে এখন তো তাঁর মেয়ের বাড়ি ফিরে আসার সময়। কিন্তু, ‘আমি আছি অনেক দূরের দেশে, যেইখানেতে সকাল ওঠে ধীরে— সূর্য ঝিমায় বিকেলবেলার ঘরে, চাঁদটা ডোবে রাত পোহানো জলে।’

সেই মার্চ মাসে যখন করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন শুরু হলো, তখন ভেবেছিলাম, ডিসেম্বর আসতে তো এখনো দেরি আছে। তার আগেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কাজেই ডিসেম্বরে দেশে গিয়ে কী করব, কোথায় যাব, আর কী কী খাব সেটারও একটা তালিকা করে ফেলেছিলাম। প্রতিবছর ডিসেম্বরে যখন বড়দিন আর শীতের ছুটি পাই, তখন শীতের পাখিদের সঙ্গে আমিও উড়ে বাড়ি ফিরে যাই। পরিবার নিয়ে লন্ডনে থাকা আমার ভাইও বাড়ি ফিরে আসে। আমাদের ভাইবোন আর তাঁদের কচিকাঁচাদের ফুর্তির গরমে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আমাদের বাড়িতে শীত নামতে পারে না। কিন্তু এ বছর সময়ের বহু আগেই আমাদের বাসায় শীত নেমে এল।

মা এত দিন বলেছেন, ‘ডিসেম্বর মাস আসতে আর কত দেরি? আমি তো দিন গুনছি!’ মা এখন আর কিছু বলেন না। শুধু বলেন, ‘বহুদিন হয়ে গেছে তোমাদের জড়িয়ে ধরি না।’ ভিডিও কলে মায়ের দিকে তাকিয়ে আমি হাসি। এমন একটা ভাব করি, যেন এটা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু আমরা আমাদের এই সামান্য অভিনয়টুকু বুঝি।

আমরা আলাপ-আলোচনা করি, প্লেন তো চলছে। কী করব? কিন্তু সবার ভালোর জন্য মহামারির এ সময় নিজেদের আবেগ যে আরেকটু সামলে চলতে হবে। তাই এই পরিস্থিতি আমাদের মেনে নিতে হয়।

নেদারল্যান্ডসে থাকা আমার পরিচিত এক আপুর কথা মনে পড়ল। তাঁর তিন বছরের মিষ্টি মেয়েকে আদর করে তিনি ডাকেন টুনু। টুনু এখন জানালার গ্রিল ধরে ঝুলতে শিখেছে। বিদেশে পড়াশোনার ফাঁকে দেশে থাকা টুনুর জন্য তাঁর মন ছটফট করে। একদিন দেখলাম ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘রাত্রি গভীর হলে আমার ঘরভর্তি সুবাস পাই। টুনুর চুলের সুবাস, টুনুর গলার সুবাস, টুনুর মুখের সুবাস। টুনু আমার সঙ্গে কথা বলে, টুনু আমার পাশে শুয়ে থাকে, টুনু ঘুমাতে চায় না, টুনু রাত জেগে খেলে। টুনুতে মগ্ন জীবন আমার টুনুময় স্মৃতিকাতরতায় এক অদ্ভুত টুনুহীনতায় কুঁকড়ে যায়, দুমড়ে যায়, মুচড়ে যায়।’

আমরা দেশে থাকা আমাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলি, ভিডিও কলে দেখাও করি, কিন্তু ছুঁতে পারি না। সকাল-সন্ধ্যা চা আর ঝালমুড়ির বাটি হাতে গল্প হয় না আমাদের। আমরা দেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকি। কবে প্রকৃতি আমাদের ছুটি দেবে, কবে বাড়ি যাব! কারও কারও কাছের মানুষ হয়তো এরই মধ্যে চিরদিনের জন্য ছুটি নিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

এই বিশাল পৃথিবীর কোটি কোটি বছরের ইতিহাসে আমরা হয়তো বিন্দুর মতো বা অদৃশ্য, তারপরও আমরা অহংকার করি, বড়াই করি, লড়াই করি। প্রকৃতি যেন বলতে চাইছে, ‘তোমার কিসের দাপট এত?’ না, আমি কিছুই না, আমি ক্ষুদ্র, আমি সামান্য। আমি শুধু আমার প্রিয় মানুষগুলোকে আরও বেশি ভালোবাসতে চাই। শীতকালে চুলার পাশে বসে ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা খেতে চাই, চেনা-অচেনা মানুষের ভাঁজে আমার শহরের অলিতে–গলিতে ঘুরে বেড়াতে চাই। বিষাক্ত পৃথিবীর শেষে এবার একটা বিশুদ্ধ পৃথিবী পেতে চাই।

মাধবীলতা গাছের পাশে বসে আমার ধারণা, মা এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো প্লেন দেখছেন, নয়তো পাখি। আর আমার মন পাখির মতো উড়ে গিয়ে কিচিরমিচির করছে সেই চড়ুইপাখিদের সঙ্গে, বারান্দার পাশে, আমার মায়ের কাছে।