করিম বাউলের গানের স্কুল
১২ সেপ্টেম্বর ছিল বাউল শিল্পী শাহ আবদুল করিমের মৃত্যুদিন। জীবদ্দশায় একটি গানের স্কুল গড়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। স্কুলের জন্য ঘরও তৈরি করেছিলেন। করিম বাউলের সেই স্বপ্নের স্কুলের খবর জানাচ্ছেন শাকুর মজিদ


দিরাই থেকে কালনী নদী, তারপর বরাম হাওর হয়ে প্রায় সোয়া ঘণ্টার পথ পেরিয়ে উজানধল গ্রামের শাহ করিমের বাড়ির ঘাটে যখন আমাদের নৌকাটি ভিড়ল, তখন ভরা বর্ষা। বর্ষায় বরাম হাওর আর বাড়ির পাশের কালনী নদী তখন মিলেমিশে একাকার। ঘাটে পৌঁছেই প্রথমে চোখে পড়ল ইটের গাঁথুনি দেওয়া চারকোনা একটি ঘর। এটা ২০০৩ সালের ২২ অক্টোবরের ঘটনা। সেবারই প্রথম গিয়েছি শাহ আবদুল করিমের বাড়িতে। বাড়িটি কালনী নদীর গা ঘেঁষে। নদীপাড় থেকে আড়াআড়ি একটা ছোট রাস্তা সোজা গিয়ে ঢুকেছে বাড়িতে।
খাল-বিল বা জলাশয়ের ওপর মাচাং-জাতীয় ঘর যে রকম হয়ে থাকে, এই ঘরও অনেকটা সে রকম। কতগুলো কংক্রিটের কলামের এক জায়গায় টেনে রাখা হয়েছে গ্রেডবিম, তার তলা বরাবর বর্ষার পানি। ঘরটি সম্পর্কে তখনো তেমন কিছু জানি না আমি। বিকেলবেলা আমাকে ওই ঘরের সামনে নিয়ে এলেন শাহ আবদুল করিম। বললেন, ‘এটা হবে আমার একটা স্কুলঘর।’

ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, ২৪ ফুট বাই ২৪ ফুট বর্গাকারের ঘরটির ছাচ তৈরি হয়েছে মাত্র। চারপাশেই আট ফুট পরপর কলাম দেওয়া, ঘরের মাঝখানে গোলাকার চারটা কলাম। সেদিন করিমপুত্র নূর জালাল বলেছিলেন, এখানে একসময় একটা চারচালা শণের ঘর বানিয়েছিলেন শাহ করিম। ঘরটিতে বসে অনুরাগী বাউলদের নিয়ে গান করতেন। কখনো সারা রাত ধরে চলত আয়োজন। এরপর ২০০১ সালের দিকে এটি ভেঙে শুরু করলেন পাকা ঘর বানানোর কাজ। কাজ শুরুর প্রথমে আমেরিকাপ্রবাসী তাঁর এক ভক্ত কিছু টাকা দিয়েছিলেন, সরকার থেকেও পেয়েছিলেন একুশে পদকের অর্থ। এই অর্থেই দেওয়া হলো ইটের গাঁথুনি ও সাইনবোর্ড।
শাহ আবদুল করিমকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঘরটি নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘একটা গানের স্কুল হবে এখানে। দূর-দূরান্ত থেকে আমার যেসব ভক্ত-অনুরাগী আসেন, তাঁরা থাকবেন। গান করবেন।’
তবে ঘরের অবস্থা দেখে তখন খুব একটা আশাবাদী হতে পারিনি আমি। গ্রেডবিমের ওপর মাত্র দেওয়া হয়েছে ইটের গাঁথুনি। অনেক কাজই বাকি। মনে পড়ে, কথায় কথায় সে সময় শাহ করিম বলেছিলেন, ‘আমি গরিব মানুষ, না আছে টাকাকড়ি, না কোনো জমিজিরাত। সারা বছরই কিনে খাই, তার পরও অতিথি-মুসাফির লেগেই থাকে সারা বছর। কিন্তু ঘরটা যখন শুরু করেছি, এটা একসময় শেষ হবেই। আমি যদি নাও পারি, আমার ছেলেকে বলে যাব, সে যেন এর কাজ শেষ করে।’
২০০৩ সাল থেকে তাঁর জীবনাবসানের সময় পর্যন্ত ধীরে ধীরে কাজ চলতে থাকে ঘরটির। ২০০৫ সালে গিয়ে দেখি ইটের গাঁথুনির ওপর দেওয়া হয়েছে সাদা রঙের চুন। ঘরে লেগেছে টিনের চালা। মাঝখানের চারটি গোল কলামের ওপর চারটি টিনের চালও দেওয়া হয়েছে। আকৃতিতে ঘরটিকে এখন একটি মণ্ডপের মতো মনে হয়। ঘরের মেঝেতে গ্রেডবিম পর্যন্ত মাটি ভরাট করা হয়েছে।
২০০৯ সালে তাঁর দাফনের দিন আবার দেখলাম ঘরটি। এবার ঘরের সাদা রঙের চুনের ওপর পড়েছে নীল রঙের আস্তরণ। পাতলা স্টিল দিয়ে বানানো হয়েছে দরজা-জানালা। তার সামনে সাইনবোর্ড—‘শাহ আবদুল করিম সংগীতালয়’। ব্যস, এটুকুই।
ঘরটি নিয়ে শাহ আবদুল করিমের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে তিনি মারা যাওয়ায় সেই স্বপ্ন আর বাস্তবে পাখা মেলেনি। শাহ করিমের স্বপ্নের সংগীতালয়টির উপরিকাঠামো নির্মিত হয়েছে কোনোমতে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর এই কাঠামো এখনো বড় নির্জীব। মাঝেমধ্যে এখানে এখন নূর জালাল বাউলদের নিয়ে বসেন। কিন্তু আবদুল করিমের স্বপ্ন তো ছিল অন্য রকম। তিনি চেয়েছিলেন এখানে বসে গানের দীক্ষা নেবেন নতুন শিল্পীরা আর পুরোনো শিল্পীরা চর্চা করবেন তাঁর গান।
জীবদ্দশাতেই করিমের সুরারোপিত গানগুলো ভিন্ন সুরে গাওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন শিল্পী নিজের মতো সুর করেছেন তাঁর গানে। করিমের গানের সবচেয়ে বড় অনুরাগী ছিলেন তাঁর প্রতিবেশী দুই সহোদর রুহী ঠাকুর ও রণেশ ঠাকুর। রুহী ঠাকুর মারা গেছেন করিমের দুই বছর আগে। এখন আছেন রণেশ ঠাকুর, আবদুর রহমান, সিরাজ মিয়া প্রমুখ শিল্পী। তাঁদের নিবাস সুনামগঞ্জে। সিলেট শহরেও আছেন কয়েকজন। এখন তাঁরাই পারেন করিমের গানের মূল সুর সংরক্ষণ করতে। শাহ করিমের স্বপ্নের স্কুলঘরটিই হতে পারে তাঁর আর্কাইভ। সেখানে থাকতে পারে মূল সুরে গাওয়া তাঁর গানের ডিজিটাল আর্কাইভও।
কিন্তু নূর জালালের এসব উদ্যোগ নেওয়ার সংগতি নেই। এ ক্ষেত্রে সরকার, বেসরকারি সংস্থা কিংবা অন্য কারও সহযোগিতায় কি করিম বাউলের স্বপ্নের গানের স্কুলটি সচল ও সজীব হতে পারে না?
‘আচ্ছা, বাবার প্রায় সাড়ে ৪০০ গানকে মূল সুরে স্বরলিপিবদ্ধ করে তাঁর গানের স্কুল থেকে সেই সুরে গান গাওয়ানোর আয়জন কি খুব জটিল কিছু?’ কয়েক দিন আগে কথায় কথায় নূর জালাল যখন শাহ আবদুল করিমের স্বপ্নের স্কুল প্রসঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন, তাঁর চোখে সে সময় যেন খেলা করছিল আবেগ ও আকুতি।