করোনা রোগীর সঙ্গে থাকতে হলে

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বারান্দায় করোনার চিকিৎসা নিচ্ছেন শহিদুল ইসলাম। বাবার পাশে বসে সেবা করছেন মেয়ে তানজিলা ইসলাম
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

চলছে লকডাউন। দিনে রাস্তায় কিছু মানুষ আর যানবাহনের চলাচল, পুলিশের নজরদারি, কাগজপত্র দেখাদেখি থাকলেও রাতে সব সুনসান। কিন্তু রাতের নীরবতা ভেদ করে একটা অ্যাম্বুলেন্স যেন বাসার সামনের গলি দিয়ে শাঁ করে এগিয়ে গেল সাইরেন দিতে দিতে। হয়তো কেউ ভয়ানক শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। মনে হলো হয়তো আরেকজন মরণাপন্ন রোগীকে নিয়ে এবার হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটতে থাকবেন তাঁর স্বজনেরা। কেউ হয়তো প্রিয়জনকে আঁকড়ে ধরে রাখবেন। অনেকেই এখন লুকিয়ে না থেকে মুখোমুখি হচ্ছেন ভাইরাসের। আক্রান্ত স্বজনের পাশে থেকে করছেন দেখভাল।

এই করোনা সেবারের করোনার মতো নয়। একেবারে অন্য রকম। ভয়ানক ছোঁয়াচে। বিচিত্র রূপ নিয়ে এবার এল এই দাপুটে ভাইরাস। কত রূপ এর; দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন, বিলেতি ধরন, ব্রাজিলের ধরন। আজকাল তো শুনছি ভারতীয় ধরনের কথাও। ডাবল মিউটেনট ভাইরাস। ভোল পাল্টে পাল্টে হয়ে যাচ্ছে বেশি ভয়াল। এ সময় যাঁদের করোনা হচ্ছে, তা আক্রমণ বেশি বলছেন তাঁর স্বজনেরাও। ‘মাত্র কথাবার্তা হলো, সব স্বাভাবিক, হঠাৎ মায়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো।’ বলছিলেন মিন্টু পাল।

কোভিড–১৯ আক্রান্ত হলে শুরুতেই রোগীকে আলাদা করে দেওয়া হয়। আলাদা বাথরুম। জিনিসপত্র আলাদা। বাড়ির বাকিরাও থাকতেন দূরে। এখন যেন একটু সাহসী হয়েছেন অনেকে। আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নিয়েই অনেকে থাকছেন স্বজনের কাছে। তাঁর সেবা করছেন কাছ থেকে। আগে বেশির ভাগ রোগীর ঘরের বাইরে খাবার দিয়ে রাখা হতো। আর রোগী দরজা খুলে খাবার নিয়ে নিতেন। তবে ঘরের জানালা খুলে রাখা দরকার। কারণ, বায়ু চলাচল চাই।

রোগীর কাছে থাকতে হলে

যদি করোনা রোগীর অবস্থা স্বাভাবিক থাকে, তাহলে তিনি একা থাকাই ভালো। ঘরে যতক্ষণ রোগী আছেন, অনেক সময় তাঁর সহযোগিতার দরকার হয়। কোনো কারণে রোগীর ঘরে গেলে অবশ্যই দুজনেরই মাস্ক পরা চাই। ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন নিয়মিত। টেলিমেডিসিন সেবা তো চালু আছেই।

যদি করোনা রোগীর সেবা দরকার হয়, তিনি যদি কারও সাহায্য ছাড়া অসুবিধায় পড়েন তাহলে বাসায় একাধিক সদস্য থাকলে যিনি অপেক্ষাকৃত বয়সে তরুণ ও কম ঝুঁকিপূর্ণ, তাঁকে রোগীর ঘরে দরকারে পাঠাতে পারেন। রোগীর ঘরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। দুটি মাস্ক পরলে ঝুঁকি আরও কমে আসবে। যিনি সেবা করছেন, তিনিও কোয়ারেন্টিন মেনে চলা দরকার। পরিবারের বাকিরা তাঁদের থেকে একটু সাবধান থাকতে পারেন। যাঁরা রোগীর সংস্পর্শে আসেন, সেবা করেন, তাঁদের কমপক্ষে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন দরকার হয়। একজন আক্রান্ত হলে বাসার সবারই পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া ভালো। বয়স্ক আর যাঁদের অন্য ক্রনিক রোগ আছে (যে কারণে দেহের ইমিউন ব্যবস্থা দমে যায়) এদের ঝুঁকি খুব বেশি, তাই এমন লোক নিজে ‘কেয়ার গিভার’ হওয়াও ঠিক না। যাঁরা টিকা নিতে পেরেছেন, তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি কম। গুরুতর হচ্ছে কম।

রোগীর যত্নে যাঁরা পাশে থাকবেন, সে বিষয়ে সিডিসি কিছু নির্দেশনাও দিয়েছে—যত দূর সম্ভব রোগীর খুব কাছে না যাওয়া। মাস্ক ছাড়াও ফেসশিল্ড পরে হাতে গ্লাভস পরে অন্তত তিন ফুট দূরে থাকতে হবে। যদি আলাদা ঘর না থাকে, রোগীর সঙ্গে একই ঘরে থাকতে হয়, তাহলে দূরত্ব রেখে ঘুমান। খেয়াল রাখবেন এমন ঘরে যেন বায়ু চলাচল খুব ভালো থাকে।

এই সময়ে ঘরে অতিথি আসা একেবারে বারণ। রোগী খাবেন আলাদা ঘরে বা যে ঘরে তিনি থাকবেন, তাঁর খাবার ঘরের বাইরে দরজার পাশে রেখে দিলে তিনি নিয়ে নেবেন, বাসনপত্র হবে আলাদা। সাবান, তোয়ালে, ব্রাশ থাকবে আলাদা। দরকার হলে রোগীর এসব জিনিসপত্র একটা ছোট্ট ব্যাগে ভরে রাখুন।

কেয়ার গিভার যাতে নিজে অসুস্থ না হন, সে জন্য প্রতিদিন নিয়মিত প্রতিরোধব্যবস্থা নিতে হবে। বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। চোখ, নাক, মুখ ছোঁয়া যাবে না। আর পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে পোশাকেও। ধুয়ে ফেলতে হবে পোশাকও। রোগীর নিত্য ব্যবহার করা জিনিসপত্র নিজে ধুয়ে নিতে পারলে ভালো। এই যেমন: গ্লাস, থালা, জগ, বাটি ইত্যাদি। যদি রোগীর বাসনকোসন কেয়ার গিভারের পরিচ্ছন্ন করতে হয়, তবে হাতে গ্লাভস পরে, সাবান আর গরম জলে ধুতে হবে। এরপর সাবধানে গ্লাভস খুলে আবার হাত সাবানজলে ২০ সেকেন্ড ধুয়ে নিতে হবে।

রোগীর কোনো জিনিসপত্র কেয়ার গিভারের ব্যবহার করা যাবে না। নিজে মাস্ক পরবেন আর রোগীর ঘরে ঢোকার আগে রোগীকেও মাস্ক পরতে বলুন।

রোগীর মলমূত্র, রক্ত, লালা ধরতে হলে হাতে গ্লাভস পরতে হবে আর এগুলোর কাজ শেষ হলে গ্লাভস খুলে বর্জ্য বিনে ফেলতে হবে। তারপর আবার হাত সাবানজলে ভালো করে ধুতে হবে। রোগীর জন্য সম্ভব হলে আলাদা বাথরুম রাখুন। আর একই বাথরুম ব্যবহার করতে হলে, রোগী যেসব জায়গা ছোঁবেন, সেসব জায়গা দ্রুত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে ফেলতে হবে।

হাসপাতালে থাকতে হলে

অনেক রোগীর অবস্থা এমন হয় যে ছুটতে হয় হাসপাতালে। মা–বাবা, সন্তান বা স্বামী–স্ত্রীর একজন অসুস্থ হলে অপরজনকে যেতে হয় তাঁর সঙ্গে। তখন প্রিয়জনেরা থাকেন প্রবল দুশ্চিন্তায়, থাকে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ তবু নিজেদের সুরক্ষা যেন তাঁরা ভুলে না যান। ভুলে গেলে চলবে না, হাসপাতালের ওয়ার্ড বা কেবিন হলো সংক্রমণের উষ্ণ শয্যা। তারপরও অ্যাটেনডেন্ট কাউকে থাকতে হয়। কারণ, নানা প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনাকাটা, অনেক সময় খাবার বা অন্য দরকারি জিনিস দরকার হয়। রোগীর পুরো সময় দেখভাল করতেও একজনকে থাকতে হয়।

পরিবারের যিনি রোগীর সঙ্গে থাকবেন, তিনি স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানবেন। সব সময় মুখে মাস্ক পরে থাকা, তিন ফুট দূরত্ব রাখার সঙ্গে স্যানিটাইজার রাখা দরকার। হাত বারবার স্যানিটাইজার দিয়ে পরিচ্ছন্ন করা, সম্ভব হলে সাবানপানি দিয়ে হাত ধোয়া আর হাতে গ্লাভস পরা ভালো। কোনো কিছু না ছোঁয়া ভালো, ছুঁতে হলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। আর কখনো হাত দিয়ে নাক, মুখ ও চোখ না ছোঁয়া বিষয়টা মেনে চলতে হবে।

ঘরে ফিরে এলে সাবানজল দিয়ে স্নান সেরে নিন। গরম জল আর সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন পরনের পোশাক। দরজার বাইরে থাকবে জুতা। মাস্ক ব্যবহার করলে তা ফেলে দিতে হবে সাবধানে। নিজের মন শান্ত রাখতে হবে। আপনার মনে জোর দেখে রোগীরও মন ভালো থাকবে। ১০ মিনিট গভীর শ্বাসক্রিয়া, ধ্যান অনেক শক্তি দেয় মনে। নিজেরা পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।

অনেক সময় রোগীকে আশ্বস্ত করা বা শান্ত করার কাজ হয়ে পড়ে কঠিন। স্বাস্থ্যকর্মীরা এতটা বোঝার সময় পান না। আবার বিদেশের মতো আমাদের দেশের রোগীর আত্মীয়স্বজন কাছে না থাকলে অনেক সময় চিকিৎসার সমস্যা হয়, রোগীর ওষুধ থেকে শুরু করে অনেক চাহিদা তাঁদের পূরণ করতে হয়। কেবল ওষুধ আনাই নয়, খাইয়েও দিতে হয় রোগীকে। তাই যিনি রোগীর সঙ্গে থাকবেন তাঁর নিজের সুরক্ষা খুব প্রয়োজন।

হঠাৎ জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতা মনে পড়ল

‘আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না।

থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা আর অন্ধকার

আমি যদি বনহংস হতাম।’