করোনার দুই বছরে সখীপুরে বিয়ে ও বিচ্ছেদ দুই–ই বেড়েছে

করোনাকালে টাঙ্গাইলের সখীপুরে বিয়ে আর বিচ্ছেদ দুটোই বেড়েছে। গত দুই বছরে সখীপুর উপজেলায় ১ হাজার ৫৯০টি বিয়ে হয়েছে আর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ১ হাজার ৫৪টি। ২০১৮–১৯ সালে যেখানে মোট বিয়ে হয় ১৩৪৪টি আর বিচ্ছেদ হয় ১০৮৬টি।

করোনাকালে স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ৫২৫টি আর স্বামীর পক্ষ থেকে হয়েছে মাত্র ২৯টি। এর বাইরে দুজনের সমঝোতায়ও বিচ্ছেদ হয়েছে। বিচ্ছেদ চাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা ১৮ গুণ বেশি।

সখীপুর মহিলা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান শহীদুল্লাহ কায়সার জানান, করোনায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি মানসিক ও সামাজিক চাপের কারণে সৃষ্ট পারিবারিক কলহই বিচ্ছেদের বড় কারণ। বিবাহবিচ্ছেদের উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে আরও আছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতের অমিল, পারস্পরিক বোঝাপড়া না হওয়া, বাল্যবিবাহ, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর উদাসীনতা, পরকীয়া, নারীর শিক্ষা, নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের প্রভাব, স্বামীর মাদকাসক্তি, দীর্ঘদিন স্বামী প্রবাসে থাকা, নির্যাতন ও যৌতুকের মতো ঘটনা।

উপজেলার আটটি ইউনিয়ন ও একমাত্র পৌরসভায় মোট ১২টি নিকাহ নিবন্ধনের কার্যালয় (কাজি অফিস) রয়েছে। এসব কার্যালয় থেকে জানা যায়, ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনাকালে উপজেলার কাঁকড়াজান ইউনিয়নে বিয়ে হয়েছে ১৩১টি আর বিচ্ছেদ হয়েছে ১২৫টি; কালিয়া ইউনিয়নে বিয়ে ২৭৪টি, বিচ্ছেদ ২২২টি; বহুরিয়া ইউনিয়নে বিয়ে ৮৬, বিচ্ছেদ ৩৬; হাতীবান্ধা ইউনিয়নে বিয়ে ১৬৪, বিচ্ছেদ ৯৬টি; যাদবপুরে বিয়ে ২২৪, বিচ্ছেদ ৬৯; গজারিয়া ইউনিয়নে বিয়ে ৭৯, বিচ্ছেদ ৬২; বহেড়াতৈল ইউনিয়নে বিয়ে ১০৭, বিচ্ছেদ ১০৮ এবং দাড়িয়াপুর ইউনিয়নে বিয়ে ১৩৫ ও বিচ্ছেদের সংখ্যা ৬৭। পৌরসভার চারটি কার্যালয়ে ৪৩২টি বিয়ে হলেও বিচ্ছেদ ঘটেছে ২৭৭টি।

কেন বিচ্ছেদ

সখীপুর উপজেলা নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) সমিতির সভাপতি ও সখীপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কাজি শফিউল ইসলাম বলেন, ‘৪ মার্চ সকালে একজন কলেজছাত্রী স্বামীকে তালাক দেওয়ার বিষয়ে পরামর্শের জন্য তাঁর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আমার কার্যালয়ে আসেন। মা–বাবার অমতে দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সহপাঠী এক ছাত্রের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেন। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় কাবিন করতে না পেরে তাঁরা আদালতে গিয়ে অ্যাফিডেভিট করে বিয়ে করেন। মেয়েটি এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মেয়েটি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি এবং এসএসসিতে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। ছেলেটি পেয়েছেন বি গ্রেড। ছেলেটি এখন তাঁর স্ত্রীকে পড়াতে চান না। তবে মেয়েটির পড়াশোনার প্রবল ইচ্ছা। তাই তিনি স্বামীকে তালাক দিতে চান।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া এক নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেটি বিদেশ থেকে ছুটিতে এসে আমাকে বিয়ে করে। দেড় মাস পর আবার বিদেশ চলে যায়। আমাকে পড়াশোনা করাবে—এমন শর্তে পরিবার আমাকে ওই প্রবাসীর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। মাস ছয়েক পর শ্বশুরবাড়ির মিথ্যা তথ্যে স্বামী আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। পড়াশোনার খরচও দিতে চায় না। এভাবে এক বছর চলার পর তাকে আমি তালাক দিয়েছি।’

বিচ্ছেদ নেওয়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের বক্তব্য মিলেছে। কেউ কেউ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বিচ্ছেদ নিয়েছেন।

শফিউল ইসলাম বলেন, ‘বাল্যবিবাহ, স্বামী বিদেশে থাকা ও সম্পর্কঘটিত নানা জটিলতা নিয়ে প্রথমে দুই পরিবারে ফাটল ধরে পরে তা বিচ্ছেদে রূপ নিচ্ছে, যা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হচ্ছে।’ এ ব্যাপারে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ফিরোজা আক্তার বলেন, ‘আগে নারীর ক্ষমতায়ন এখনকার মতো ছিল না। পুরুষদের অত্যাচার সহ্য করে নীরবে সংসার করেছেন নারীরা। এখন নারীরা সচেতন, শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। তাঁদের মর্যাদা বেড়েছে। ফলে নারীরা এখন নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে চান না।’

উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলিমা খাতুন বলেন, ‘সামান্য কারণে একজন নারী কখনো বিবাহবিচ্ছেদ চান না। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন যখন সীমা অতিক্রম করে, তখন বাধ্য হয়েই একজন নারী তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা আলম মনে করেন, বিচ্ছেদ কমাতে হলে আগে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে হবে।