করোনায় পরিবেশদূষণ: ব্যবহৃত মাস্কের ভবিষ্যৎ কী?

কোথা থেকে কীভাবে এল করোনাভাইরাস, তা এখনো জানা যায়নি। এদিকে ২০২০ সালে কোভিডের সংক্রমণের শুরু থেকেই মুখের মাস্ক আর পিপিই বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায় স্বাস্থ্য খাতের সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের জন্য। করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এন৯৫ মাস্ক। এই মাস্ক যেমন খরচসাপেক্ষ, তেমনই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া মাস্ক মারাত্মক পরিবেশদূষণের কারণ হয়ে উঠছে। একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য। মেডিকেল ওয়েস্ট হিসেবে প্রতিদিন কেবল এন৯৫–এর বর্জ্য জমা হয়েছে ৭ হাজার ২০০ টন। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্যাক্সিনেশনের ফলে করোনার গতি ধীর হয়ে এসেছে, তবু স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এন৯৫–এর ব্যবহার বন্ধ হয়নি।

মাস্ক বাড়াচ্ছে পরিবেশ দূষণ
ছবি: ইনস্টাগ্রাম
কেবল স্বাস্থ্য খাতেই প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে ৭৪০ কোটি মাস্ক ব্যবহৃত হয়। যার অর্থমূল্য ৬৪০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৫৪ হাজার ৪৪১ কোটি ৭০ লাখ টাকার সমান। এই মাস্কগুলো ৮ কোটি ৪০ লাখ কিলোগ্রাম ওজনের বর্জ্য উৎপাদন করেছে।

করোনার প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা গড়ে প্রতিদিন একটি করে মাস্ক ব্যবহার করতেন। ফলে কেবল স্বাস্থ্য খাতেই ৭৪০ কোটি মাস্ক ব্যবহৃত হয়। যার অর্থমূল্য ৬৪০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৫৪ হাজার ৪৪১ কোটি ৭০ লাখ টাকার সমান। এই মাস্কগুলো ৮ কোটি ৪০ লাখ কিলোগ্রাম ওজনের বর্জ্য উৎপাদন করেছে।

এই ওজন ২৫২টি বোয়িং ৭৪৭ অ্যারোপ্লেনের সমান। যদি এই স্বাস্থ্যকর্মীরা আলট্রাভায়োলেট–রেতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের বাষ্প ব্যবহার করে মাস্কগুলো জীবাণুমুক্ত করে বারবার ব্যবহার করতেন, তাহলে ১৪০ কোটি মাস্ক কম লাগত। ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১৪ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা বেঁচে যেত। আর ১ কোটি ৩০ লাখ কেজি মাস্কের বর্জ্য বা ৫৬টি বোয়িং ৭৪৭ অ্যারোপ্লেনের সমান ওজনের বর্জ্য পরিবেশ দূষিত করত না। এটা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহৃত ছয় মাসের মাস্কের হিসাব।  

এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুয়েটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা দল জানিয়েছে, তারা পুনর্ব্যবহার করা যায়, এমন মাস্ক তৈরির আইডিয়া দেয়। এতে মাস্কের পেছনে খরচ আর পরিবেশদূষণ—দুটিই শতকরা ৭৫ ভাগ পর্যন্ত কমে আসবে। এমআইটির সহকারী অধ্যাপক ও ব্রিংহাম অ্যান্ড উইমেন’স হসপিটালের গাইনোকোলোজিস্ট জোভানি ট্রাভেসো এই গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। তিনি এই গবেষণার জ্যেষ্ঠ লেখক। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর—এই সময়ের ডেটাভিত্তিক গবেষণাটি ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে (বিএমএ) প্রকাশিত হয়।

মাস্ক এ বাড়ছে পরিবেশ দূষণ
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

শুরুতে একটা মাস্ক একবারই  ব্যবহার কার হতো। পরবর্তী সময়ে মাস্কের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু হাসপাতালে এন৯৫ মাস্কের সরবরাহ কমে যেতে থাকে। সেই সময় এমআইটির গবেষণা অনুসারে ব্যবহৃত মাস্ককে জীবাণুমুক্ত ও পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলার জন্য হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের বাষ্প ব্যবহার করা শুরু হয়। ফলে একটা মাস্ক কয়েক দিন ব্যবহার করা যেত। এরপর ট্রাভোসো ও তাঁর দল সিলিকন রাবার দিয়ে এমন একটি মাস্ক বানায়, যেটির এন৯৫ ফিল্টারের অংশটা খুলে জীবাণুমুক্ত করে আবার লাগিয়ে নিয়ে ব্যবহার করা যায়। এতে একটা মাস্কের ব্যবহারযোগ্যতা অনেকখানি বেড়ে যায়।

`মহামারির আগে থেকেই আমরা প্লাস্টিকের স্ট্র, পলিথিন কমানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছিলাম। আর মহামারিকালে এক ধাক্কায় মাস্কের বর্জ্যে ভরে উঠেছে পৃথিবী। আমাদের প্রয়োজন কমাতে হবে।'

এভাবে বেশ কয়েক ধরনের এন৯৫ মাস্ক বাজারে আসে। এগুলোর ভেতর একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয়, এক দিন ব্যবহারযোগ্য, পরিশোধনযোগ্য, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ব্যহারযোগ্য বা সার্জিক্যাল মাস্ক উল্লেখযোগ্য। ধরণা করা হচ্ছে, করোনা নির্মূল হওয়ার পরও বহুদিন পর্যন্ত মাস্কের ব্যবহার থাকবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের রোগ যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধেও, অথচ কবে কীভাবে বিশ্ব করোনামুক্ত হবে, সেই বিষয়ই এখনো অনিশ্চিত। ট্রাভেসো বলেন, ‘এই মুহূর্তে মাস্কের কোনো বিকল্প নেই। মাস্ক তো নিজেদের রক্ষা করার জন্য। সেই  মাস্ক যদি পরিবেশের ক্ষতি করে, তাতে আমরাই ভুগব। তাই আমরা চেষ্টা করছি এমন কোনো মাস্ক ব্যবহার করতে, যেটা আমাদের রক্ষা করবে, অর্থনীতির ওপর চাপ কমাবে আর যতটা সম্ভব কম পরিবেশ দূষিত করবে।’

তবু মাস্কের বিকল্প নেই
ছবি: পেকজেলসডটকম

এদিকে একই বিষয় নিয়ে আরেকটি গবেষণা করেছে যুক্তরাজ্যের সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা দল। এই গবেষণার ফলাফল নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। সেখানে বলা হয়ে যে বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া উচিত। এই গবেষণা প্রজেক্টের প্রধান ডা. শার্পার শার্প বলেন, ‘মহামারির আগে থেকেই আমরা প্লাস্টিকের স্ট্র, পলিথিন কমানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছিলাম। আর মহামারিকালে এক ধাক্কায় মাস্কের বর্জ্যে ভরে উঠেছে পৃথিবী। আমাদের প্রয়োজন কমাতে হবে। ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। নিজেদের বাঁচাতে পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। সেটা বুমেরাং হয়ে ফিরে এসে আবার আমরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হব। কেননা, মাস্কের এই বর্জ্য থেকে লেড, এন্টিমনি আর ক্যাডমিয়ামের মতো বিষাক্ত উপাদান পাওয়া গেছে। যেগুলো মাটিতে মেশে না বললেই চলে।’

‘নিজেদের বাঁচাতে পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। সেটা বুমেরাং হয়ে ফিরে এসে আবার আমরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হব।’

এই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, মাস্কের ফলে যে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, এটা এই মুহূর্তে কোনো বড় সমস্যা না। কেননা, এখন আমরা আরও বড় সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। তবে কেবল মাস্কের মাধ্যমে যে পরিবেশদূষণ, সেটি একসময় বড় সমস্যা হয়ে উঠবে। তাই এই মুহূর্তে নিজেকে নিরাপদ রাখার পাশাপাশি পুনরায় ব্যবহারযোগ্য ও জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা যায়, এমন ভালো উপাদানে তৈরি মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।