কাজল রেখা এখন সবার কণ্ঠস্বর

হাতের জোরে হুইলচেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর মুখে এক ফালি হাসি ফুটিয়ে নিজে থেকেই বলতে শুরু করলেন, ‘নাম কাজল রেখা। জেলা গাইবান্ধা, থানা সুন্দরগঞ্জ…।’ তাঁর সঙ্গে কথা বলব জেনেই একনাগাড়ে নিজের পুরো বৃত্তান্ত বলতে থাকেন। তারপর প্রশ্ন চোখে তাকান আমাদের দিকে। জানতে চাই, এখানে কেন এসেছেন? ‘আমার কাজের কথা বলতে।’ এবার সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন কাজল রেখা।
বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্টের (সিডিডি) ২০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে গত ২৯ আগস্ট দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। রাজধানীর মিরপুরে পুলিশ স্টাফ কলেজ সম্মেলন কেন্দ্রের সে আয়োজনেই কাজল রেখার নানান কাজের কথা আমরা জানতে পারি।
কাজল রেখা তাঁর মতো শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন, তা নিয়েই উচ্চকণ্ঠ। তাঁর এলাকায় উঠান বৈঠকের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সম্পর্কে যেমন সচেতন করেন, তেমনি নিজেদের কষ্টের কথা তুলে ধরেন নীতিনির্ধারণী মহলে। ইউনিয়ন, উপজেলা আর জেলা পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য তিনি।
শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মেলনেও পৌঁছে গেছে কাজল রেখার কণ্ঠ। আমার পাশেই বসা ছিলেন সিডিডির কর্মকর্তা রাজিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, ‘কাজল রেখা নিজের আকুতির কথা ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, সুইজারল্যান্ড, জাপানসহ আটটি দেশে বড় সম্মেলনে বলে এসেছেন।’ এ কারণেই কাজল রেখা হয়ে উঠেছেন তাঁর এলাকার প্রতিবন্ধী মানুষের কণ্ঠস্বর।
এই কাজল রেখার কাছেই ১৩ বছর আগে ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটি ছিল অজানা। আজ যে হুইলচেয়ার নিত্যসঙ্গী, সে চেয়ারও ছিল অদেখা। দুরন্ত শৈশবে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিস্তাপারের গ্রাম লাহেরীর খামার হৈ-হুল্লোড়ে মাতিয়ে রাখত কাজল রেখাদের দলটি। ছয় ভাই আর তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট কাজল রেখা। সোনালি কৈশোর পেরিয়ে ২০০১ সালে অংশ নেন মাধ্যমিক পরীক্ষায়। ফল বেরোলে দেখা যায় এক বিষয়ে অকৃতকার্য। তত দিনে বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন। একদিন বড় ভাইয়েরা তাঁর বিয়ে দেন পাশের ইউনিয়নে। তারপর দিন যায়, বছর ঘোরে। ‘ভালোই যাচ্ছিল সবকিছু।’ বলেন কাজল রেখা।
২০০৩ সালের সেদিনের বিকেলটি কাজলরেখা কিছুতেই যেন ভুলতে পারেন না। কয়েক সেকেন্ডেই বদলে গেল তাঁর জীবন। হুইলচেয়ারের জীবনের গল্প শুনতে চাইলে কাজল রেখা আমাদের নিয়ে যান সেই ১৩ বছর আগের বিকেলে। ‘বিকেলে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে শিম পাড়তেছিলাম। হঠাৎ টুল পিছলে পড়ে যাই।’ আচমকা সেই ফসকে পরে যাওয়াটাই কাল হয় কাজল রেখার জীবনে। কোমরে প্রচণ্ড আঘাত পান। উঠে বসা বন্ধ হয়। স্থানীয়ভাবে চিকিত্সা চলে। কিন্তু কোনো উন্নতি হয় না। মাস তিনেক বিছানায় শুয়ে থাকার ফলে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঘা দেখা দেয়। মাথার চুল ঝরে পড়তে শুরু করে। দুঃখের দিন পেয়ে বসে কাজল রেখাকে।
এরপর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সা করা হয়। কিন্তু অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয় না। একসময় চলাচলের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন কাজল রেখা। তখন কোনো কাজই অন্যের সহযোগিতা ছাড়া আর করতে পারেন না তিনি।
কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ ভিজে এল। তবু বলতে থাকেন, ‘সে সময় স্বামীও আমারে ছেড়ে চেলে যায়। কিছুদিন পর শুনি আরেকটা বিয়ে করিছে।’ একে তো শারীরিক যন্ত্রণা, তাঁর সঙ্গে যোগ হয় মানসিক পীড়ন। শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন কাজল রেখা। ‘আমার তখন জায়গা হয় জলচৌকিতে। ভাবিরা যেভাবে ফেলে রাখে, সেভাবেই থাকতে হয়।’ আর এভাবেই তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে যায় চার বছর।
২০০৮ সালে গণ-উন্নয়ন কেন্দ্র (জিইউকে) নামে একটি প্রতিষ্ঠান একটি হুইলচেয়ার দেয় তাঁকে। ‘এই চেয়ারে ঘুরলে মানুষ কী বলবে? আমি তো নিতে চাইনি। তারপরও সবকিছু বুঝে সুঝে দিয়ে যায়।’ বলে যান কাজল রেখা। কিন্তু বাড়ি ও গ্রামের পরিবেশ হুইলচেয়ার চলাচলের উপযোগী ছিল না। তাঁকে সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়তে হতো বন্যার সময়। এ সময় অন্যরা বাঁধে আশ্রয় নিলেও তাঁকে বাড়িতেই মাচা করে বসিয়ে রাখা হতো। ২০১০ সালে কাজল রেখাকে সিডিডির প্রতিবন্ধিতাবান্ধব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এরপর জীবনের মোড় ঘুরে যায় কাজল রেখার। তাঁকে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শারীরিক সুস্থতার জন্য চিকিৎসাসেবাও দেওয়া হয়। এই সংস্থা থেকেই তাঁকে ভেড়া ও ছাগল পালন, হাঁস-মুরগি পালন, বসতভিটায় সবজি চাষ, খাঁচায় মাছ চাষসহ সেলাইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কাজল রেখা এখন সেলাই মেশিন চালান। গ্রামের মানুষের পোশাক তৈরি করে দেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখন আলাদা খাই। আমার কাজে একজন সাহায্যও করে।’ কথা শেষ হতেই কাজল রেখার চোখেমুখে আত্মতৃপ্তির আভা ফুটে ওঠে।
আমরা আরও কিছু জানার জন্য কাজল রেখাকে প্রশ্ন করি। কিন্তু ততক্ষণে মঞ্চে ওঠার জন্য ডাক পড়ে কাজল রেখার। কারণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সে পর্বে তিনিও একজন আলোচক।