কোকো শ্যানেল: এক বিস্ময়কর কিংবদন্তি

মাদমোয়াজেল গ্যাব্রিয়েল শ্যানেল (১৮৮৩-১৯৭১)
কোকো শ্যানেল

‘আপনি কি দেখেছেন কোকোকে?

কোকো, অনেক আদরের কুকুর আমার, হারিয়ে গেছে ত্রোকাদেরোর কাছে।...’

মধ্য ফ্রান্সের ভিশি শহরের এক ক্যাফেবারের আলোঝলমল মঞ্চে বেহালা আর একর্ডিয়নের সুর ছাপিয়ে সুললিত কণ্ঠে গান গাইছেন এক সুন্দরী নারী। আর সেখানে দিন শেষে ক্লান্তি দূর করতে এসেছেন দশম রেজিমেন্টের চৌকস এবং তরুণ সেনা কর্মকর্তারা। তালে তালে নাচছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে রয়েছে শহরের অভিজাত, নারী-পুরুষ। জোড়ায় জোড়ায় নাচের ছন্দ উত্তাল হয়। গানের কলি থেকে যে শব্দটি নানা বাদ্যযন্ত্রের সুরের সঙ্গে ঝংকার তোলে তা হলো ‘কোকো’। ১৯০৭-১৯০৮ সালের কথা।

একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে সুরের মূর্ছনা তুলেছেন চব্বিশ বছরের বুদ্ধিদীপ্ত আকর্ষণীয় চেহারার এক তরুণী। আলোয়ে উদ্ভাসিত হচ্ছে তাঁর স্নিগ্ধ শান্ত অবয়ব, দীর্ঘ গ্রীবায় শোভা পাচ্ছে নকল মুক্তোর মালা। পরনে খানিটা ভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় পোশাক। যেকালে নারীরা নিজেদের গতানুগতিক পোশাক থেকে মুক্ত করতে পারেননি, সে সময়ে কিছুটা খোলামেলা পোশাকে নিজেকে প্রকাশ করেছেন মার্জিত এবং আভিজাত্য মেশানো এক অদ্ভুত সৌন্দর্যবোধে।

বয় কাপেল এবং গ্যাব্রিয়েল শ্যানেল।
জঁ লবুর্ন– এর লেখা ‘নতর শ্যানেল’ বই থেকে

তরুণ অফিসারদের দৃষ্টি ঘুরে-ফিরে তাঁর দিকেই ফিরে আসে, মনে প্রশ্ন জাগে, কী তাঁর পরিচয়, কী নামে ডাকব তাকে? তাঁর নাম দেওয়া হয়, ‘কোকো’, সেই থেকে তিনি ‘মাদমোয়াজেল কোকো’। আর তাঁর পরিচয়?

মঞ্চ আলো করে সংগীতের সুরে ঝংকার তুললেও, নিজের অদূর অতীত অনেকটাই অন্ধকারে ঢাকা, অনেক বেশি বেসুরো।

কোকো শ্যানেল নামের আড়ালে তাঁর দ্বিতীয় জন্ম হলেও, তাঁর আসল নাম ছিল গ্যাব্রিয়েল বনোহওর শ্যানেল। জন্মেছিলেন ফ্রান্সের সমুর নামে এক ছোট্ট শহরে এক হতদরিদ্র কুমারী মায়ের ঘরে।

তখন শেষ রাত, সমগ্র পৃথিবী নতুন একটি দিনের অপেক্ষায়, সেদিনটি ছিল ১৯ আগস্ট ১৮৮৩। যখন তাঁর বয়স মাত্র বারো, তখন একমাত্র আশ্রয় মা যক্ষ্মা রোগে মারা যায়। এরপর আশ্রয় হয় এক অনাথ আশ্রমে। সেখানে অযত্নে, অবহেলায় বেড়ে ওঠা এই কিশোরীর চোখেমুখে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রদীপ্ত এক অলীক প্রভা। আশ্রমে তারুণ্যের ছয়টি বছর তাঁকে কৃচ্ছ্রসাধন এবং কঠিন নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়েছে। সেখানে থাকতেই তিনি সেলাই এবং সূচিকর্মে নিজেকে দক্ষ করে তোলেন। পোশাক তৈরি করতে গিয়ে গতানুগতিক ধারা পরিহার করে নিজের শিল্পচেতনাকে কাজে লাগিয়ে একটু ভিন্ন ধরনের পোশাকপরিচ্ছদ তৈরি করতে শুরু করেন। তবে এ কথা সত্য যে, তাঁর ছোটবেলার জীবনের অনেকটাই অস্পষ্ট রয়ে গেছে। কেউ কেউ জানিয়েছেন যে, তিনি বারো বছর বয়সে জীবিকার জন্য গৃহপরিচারিকার কাজও করেছেন। জীবদ্দশায় তিনি নিজের অতীতকে নিয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করতেন না। তাঁর দৃষ্টি ছিল ভবিষ্যতের দিকে।

যখন তাঁর বয়স মাত্র বারো, তখন একমাত্র আশ্রয় মা যক্ষ্মা রোগে মারা যায়। এরপর আশ্রয় হয় এক অনাথ আশ্রমে। সেখানে অযত্নে, অবহেলায় বেড়ে ওঠা এই কিশোরীর চোখেমুখে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রদীপ্ত এক অলীক প্রভা।

আঠারো বছর বয়স হলে তাঁকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তখন তিনি মধ্য ফ্রান্সের মুলা শহরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে সেলাই এবং পোশাক তৈরিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। অনেকটাই সম্বলহীন, তাই তিনি এই স্কুলের বেতন পরিশোধে অপরাগ ছিলেন। এ কারণে তাঁকে প্রচণ্ড অবহেলা সইতে হতো। ধনী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যেমন সদাচরণ করা হতো, গ্যাব্রিয়েলের সঙ্গে তার উল্টোটা করা হতো। ১৯০৩ সালে তিনি একটি পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন।

১৯০৭-১৯০৮ সালের দিকে, তিনি তাঁর ভাগ্য ফেরাবার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেন এবং ভিশি শহরের কেন্দ্রে জাঁকিয়ে বসা এক সুদৃশ্য ও বিশাল ‘গ্র্যান্ড ক্যাফে’তে নিয়মিত যাওয়া আসা শুরু করেন। এই বিশাল ক্যাফেবারে আসা যাওয়া ছিল শহরের সব অভিজাত শ্রেণির মানুষদের, বিশেষ করে দশম রেজিমেন্টের তরুণ সেনা অফিসারদের আনাগোনায় মুখরিত ছিল গ্র্যান্ড ক্যাফে। এমনকি নাচ-গানের অনুষ্ঠানে প্রায়ই তিনি একটি গান গাইতেন। শুরুতেই সে কথা বলা হয়েছে।

শ্যানেলের পোশাকে ৬০-এর দশকের ফরাসি নারী
সংগৃহীত

এ সময়ে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে অনেক ধনাঢ্য তরুণের সঙ্গে। এর মধ্যে এতিয়েন বালসান ছিলেন তাঁর একজন খুব ভালো বন্ধু। যার হাত ধরে তিনি পা রাখেন অভিজাত এবং সম্ভ্রান্তদের ঐশ্বর্যময় দুর্ভেদ্য জগতে। অভিজাত মহলের প্রবেশের দরজা খুলে গেলে দ্রুত রপ্ত করেন এ জগতের মানুষের আচার-আচরণ, সামাজিক অনেক আদবকেতা। নিজেকে তৈরি করে নেন সমাজের উঁচু ধাপের একজন হিসেবে। এতিয়েনের মাধ্যমে পরিচয় হয় মাথা ভর্তি কালো ঝাঁকড়া চুলের ধনাঢ্য ইংরেজ ব্যবসায়ী আরেক তরুণের সঙ্গে, নাম আরতুর কাপেল। অনেক নারীর স্বপ্নের পুরুষ আরতুর কাপেলের আরেকটি নাম ছিল ‘বয়’। বয় কাপেল একজন দক্ষ ঘোড়সওয়ার ছিলেন। ঘোড়ার পিঠে চেপে পোলো খেলায় তাঁর জুড়ি ছিল না। পরিচয় থেকে পরিণয় গড়ে ওঠে এই দুজন স্বপ্নবাজ তরুণের মধ্যে। এ সময়ে তাঁরা দুজনে একসঙ্গে বসবাস শুরু করেন।

তারপরও গ্যাব্রিয়েল নিজে থেকে কিছু একটা করতে চাইতেন। খুব সুন্দর মেয়েদের হ্যাট অর্থাৎ টুপি তৈরি করতে পারতেন। সেসব হ্যাটে ছোঁয়া লেগেছিল শ্যানেলের শিল্পনৈপুণ্যের। ফলে সহজেই তিনি উঁচুমহলের আধুনিক এবং ফ্যাশন সচেতন নারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। বয় কাপেলর অর্থ সাহায্যে ১৯১০ সালে তিনি ‘শ্যানেল মোদ’ (ফ্যাশন) নামে প্যারিসে তাঁর প্রথম বুটিকটি খোলেন। এরপর আর তাঁকে ফিরে তাকাতে হয়নি।

হ্যাটের সঙ্গে মেয়েদের পোশাক ডিজাইনে এনেছিলেন নূতনত্ব। নারীকে দিয়েছিলেন গতানুগতিক আটপৌরে পোশাক থেকে মুক্তি।

সেই শুরু, হ্যাটের সঙ্গে মেয়েদের পোশাক ডিজাইনে এনেছিলেন নূতনত্ব। নারীকে দিয়েছিলেন গতানুগতিক আটপৌরে পোশাক থেকে মুক্তি। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় ছিল সৃষ্টি সুখের উল্লাস, শিল্পের সুষমা যা নারীকে নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিল। মোহিনী মায়াকে রূপ দিয়ে করেছিলেন আবেদনময়ী। ১৯১৮ সালে তিনি বেশ কয়েকটি বিপণির মালিক এবং একজন পরিচিত মানুষ। তত দিনে তাঁর কারখানায় কাজ জুটেছে তিন শ'র বেশি শ্রমিকের।

প্যারিসের পাতাল রেল স্টেশনে কোকো শ্যানেলের বিজ্ঞাপন।
লেখক

প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে বয় কাপেল গ্যাব্রিয়েলকে বিয়ে করতে চাইলে, বয়ের মা তাতে বাঁধ সাধেন; আভিজাত্যের ভারসাম্যহীন অহংবোধে উন্মত্ত হয়ে তিনি ভীষণভাবে অপমান করেন গ্যাব্রিয়েলকে। বয় বিয়ে করেন অন্য একজনকে। এরপর ১৯১৯ সালে বড়দিনের সময় গ্যাব্রিয়েলের সঙ্গে দেখা করতে মহাসড়ক ধরে আসার সময় ২২ ডিসেম্বর রাতে মোটর দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারান বয় কাপেল। ফেলে আসা ভালোবাসার কাছে তাঁর আর ফেরা হয়নি।

কারও মৃত্যুতে জীবন কখনো থেমে থাকে না। গ্যাব্রিয়েল থেমে থাকেননি, বয় কাপেলের হাত ধরে যে প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছিলেন, তাকে নিজের প্রতিভা আর দক্ষতা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান অনেকখানি পথ। অতি দ্রুত তাঁর খ্যাতি ইউরোপের সীমা ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় আমেরিকায়। রাশিয়ার অভিজাত মহলেও পৌঁছে যায় ‘শ্যানেল মোদ’, ‘গ্যাব্রিয়েল শ্যানল’ এর পোশাক, মেক-আপ, টুপি, ফার, জুতোর বিশ্বজোড়া সুনাম। সমগ্র পৃথিবীর নামি-দামি শিল্পী থেকে রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্য। পুরুষশাসিত সাম্রাজ্যে গড়ে তুললেন নিজের বিশাল ফ্যাশান সাম্রাজ্যে।

আর্নেস্ত বো অনেক পরিশ্রম করে বেশ কিছু সুগন্ধি উদ্ভাবন করে গ্যাব্রিয়েলকে বেশ কিছু নমুনা থেকে একটি পছন্দ করে নিতে বললেন। গ্যাব্রিয়েল পাঁচ নম্বরটি পছন্দ করলেন। সেই থেকে জগদ্বিখ্যাত ‘শ্যানেল ফাইভ’ এক কিংবদন্তি সুগন্ধি।

"যে নারী পারফিউম ব্যবহার করে না সে তার ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়েছে"- পোল ভ্যালেরির এই কথাটি গ্যাব্রিয়েল শ্যানেলের খুব পছন্দের ছিল। গ্যাব্রিয়েল তাই চাইলেন একটি সুগন্ধি।

নাম করা সৌগন্ধিক আর্নেস্ত বো এর সঙ্গে ১৯২১ সালে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি তাঁকে একটি পারফিউম উদ্ভাবনের জন্য বলেন। আর্নেস্ত বো জানতেন, পারফিউম যেমন সরল তেমনই জটিল। তিনি অনেক পরিশ্রম করে বেশ কিছু সুগন্ধি উদ্ভাবন করলেন। গ্যাব্রিয়েলকে বেশ কিছু নমুনা থেকে একটি পছন্দ করে নিতে বললেন। গ্যাব্রিয়েল পাঁচ নম্বরটি পছন্দ করলেন। সেই থেকে জগদ্বিখ্যাত ‘শ্যানেল ফাইভ’ এক কিংবদন্তি সুগন্ধি, নারী আর তাঁর একান্ত আপন সৌরভের কবোষ্ণ মিলন।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তাঁর সকল ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রাখেন। এর ১৫ বছর পরে ১৯৫৪ সাল, তখন তাঁর ৭১ বছর বয়স, আবারও অনেক বাধাবিপত্তি ঠেলে নতুন করে কাজ শুরু করেন।

বিশ্বে সর্বাধিক সমাদৃত পারফিউম কোকো শ্যানেলের বিজ্ঞাপন।
কোকো শ্যানেল

১৯৫৭ সালে তিনি ফ্যাশনে অস্কার পুরস্কার পান। এ অনুষ্ঠানে মেরিলিন মনরোকে এক সাহসী সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার রাত-পোশাকটি কেমন জানতে পারি কি?’ উত্তরে জনমোহিনীর চটুল এবং ত্বরিত উক্তিটি ছিল, ‘কয়েক ফোঁটা শ্যানেল ফাইভ।’

জীবনের শেষ তিরিশটি বছর তিনি প্যারিসের হোটেল রিৎজে কাটান। ১০ জানুয়ারি ১৯৭১, সেখানেই তিনি দীর্ঘ ৮৭ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের যবনিকা টানেন।

মেরিলিন মনরোকে এক সাহসী সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার রাত-পোশাকটি কেমন জানতে পারি কি?’ উত্তরে জনমোহিনীর চটুল এবং ত্বরিত উক্তিটি ছিল, ‘কয়েক ফোঁটা শ্যানেল ফাইভ।’

গ্যাব্রিয়েল বনোহওর শ্যানেল, আমরা যাঁকে চিনি কোকো শ্যানেল নামে, কপর্দকহীন এক অসহায় অনাথ শিশু থেকে একান্তই নিজের চেষ্টায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সীমাহীন বিশাল এক সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী। ফরাসিদের জীবনধারা, শিল্প-সংস্কৃতি আর কৃষ্টিতে যাঁরা স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন, তিনি তাদেরই একজন, ফ্যাশন জগতের আইকন। নক্ষত্রের পতন হয়, কিন্তু তা কখনোই মিলিয়ে যায় না।