কোপেনহেগেনেও তো পুরুষ আছেন!

কোপেনহেগেনে মেয়েরা সাইকেলে চড়ে নিরাপদে ঘুরে বেড়ায় l ছবি: সংগৃহীত
কোপেনহেগেনে মেয়েরা সাইকেলে চড়ে নিরাপদে ঘুরে বেড়ায় l ছবি: সংগৃহীত

ঝকঝকে রাস্তায় যানজট নেই। গাড়ির হর্ন নেই। সিগন্যালে মাঝেমধ্যে সাইকেলের জট। সাইকেল আরোহীদের মধ্যে আবার নারীর সংখ্যাই বেশি। তা নিয়ে অবশ্য সেই শহরের কারও মধ্যে কোনো কৌতূহলও নেই। শুধু সাইকেল চালানোর সময় নয়, নারীরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন অথচ কোনো পুরুষ কু-দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন না। নারীর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেউ গুঁতো দিচ্ছেন না। বাজে কথা বলছেন না। এসব দেখে মাথার মধ্যে একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খায়—এখানেও তো পুরুষ আছেন! তাহলে নারীরা কীভাবে এতটা স্বাধীনভাবে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন? বলছিলাম ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের কথা। ১৪ থেকে ২০ মে পর্যন্ত শহরটিতে যেটুকু সুযোগ পেয়েছি, ঘুরেছি। সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশি এবং ডেনমার্কের নাগরিকদের মুখ থেকে যতই শুনি এখানে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে নিরাপদ, তারপরও মনে হয়েছে, এই বুঝি কোনো পুরুষ কোনো নারীর সামনে এসে খারাপ ব্যবহার করবেন। সেই অভিজ্ঞতার কোনো সুযোগই ঘটেনি; বরং রাস্তাঘাটে যেকোনো সমস্যায় পুরুষেরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের সব পুরুষ খারাপ আমি কিন্তু তা বলতে চাইছি না। এখানেও ভালো পুরুষ আছেন বলেই নারীরা বাইরে কাজ করতে পারছেন।
সুযোগের তো অভাব নেই। সেখানে রাতের বেলা নারীরা রাস্তায় দৌড়াচ্ছেন, হাঁটছেন, সাইকেল চালাচ্ছেন। সেখানে শুধু যে সেই দেশের নারীরা নিরাপদ তা-ই নয়, অন্য দেশের নারীদেরও তো বাজে অভিজ্ঞতা নেই।
একদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে রওনা দিয়ে প্রায় ৪০ মিনিটের হাঁটাপথ হেঁটে হোটেল কেবিন মেট্রোতে পৌঁছালাম। রাত সাড়ে ১১টা মানে অনেক রাত। রাত তো শুরু হয়ে যায় সূর্যের আলো থাকা অবস্থায়। আমার সঙ্গে ছিলেন ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদক পরিমল পালমা। আমার ব্যাগে ল্যাপটপ, ডলার—সবকিছু। যে জায়গা দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে তা বেশ নিরিবিলি। বসতি খুব কম। রাস্তায় মানুষ বলতে গেলে হাতে গোনা যাবে। বাংলাদেশের অন্য অনেক মেয়ের মতো আমার মনেও কিছুটা ভয় ছিল। কেউ যদি সামনে এসে দাঁড়ায় কিছুই বলার থাকবে না। প্রায় সময়ই মনে হলো এই বুঝি গাড়ি সামনে এসে থামল! কিন্তু কিছুই হলো না। এমনকি রাস্তার কেউ তাকিয়েও দেখল না যে এত রাতে এই নারী কোথায় যায়? হোটেলে ফিরে মনে হলো, এটা তো কোপেনহেগেন। বিশ্বের যে শহরগুলোতে নারীরা নিরাপদে একা চলাচল করতে পারেন, সেই তালিকা বা সূচকে প্রথম দিকেই চলে এসেছে কোপেনহেগেনের নাম।

মা ও সন্তানদের আনন্দ–ভ্রমণ l ছবি: সংগৃহীত
মা ও সন্তানদের আনন্দ–ভ্রমণ l ছবি: সংগৃহীত

কোপেনহেগেন গিয়েছিলাম নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল অ্যাডভোকেসি এনজিও উইমেন ডেলিভার আয়োজিত চতুর্থ গ্লোবাল উইমেন ডেলিভার সম্মেলনে যোগ দিতে। ডেনমার্ক সরকার, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল, ইউএন-উইমেনসহ বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এ সম্মেলন আয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। কোপেনহেগেনের বেলা সেন্টারে বিশ্বের ১৬৯টি দেশের প্রায় ছয় হাজার প্রতিনিধি মিলিত হন।
ডেনমার্ক মায়েদের কাছেও স্বর্গরাজ্য। গত বছরের সেভ দ্য চিলড্রেনের বার্ষিক প্রতিবেদন মাদারস ইনডেক্স মতে, মায়েদের জন্য সবচেয়ে ভালো দেশের তালিকায় ডেনমার্কের অবস্থান চতুর্থ। কোপেনহেগেনের পরিচিত দৃশ্য—পেরামবুলেটার করে, বুকের সঙ্গে লাগিয়ে বাবা অথবা মা সন্তানকে সঙ্গে নিয়েই বিভিন্ন কাজ করছেন। পেরামবুলেটার নিয়ে মায়েরা ট্রেন বা বাসেও উঠছেন। একজন গর্ভবতী নারীকে সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখে আমার চোখ কপালে উঠলেও অন্যদের ভাবগতিক দেখে অসম্ভব বলে কিছু মনে হলো না।
ডেনমার্কে সন্তানের সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের একটি। সন্তান জন্মের পর সন্তানের প্রয়োজনে ছুটির ক্ষেত্রে বাবা-মা দুজনেই প্রায় সমান সুযোগ পাচ্ছেন। মা সন্তান জন্মের আগে-পরে মিলে ৫০ সপ্তাহ এবং বাবারা সন্তান জন্মের পর ৩৪ সপ্তাহ পর্যন্ত ছুটি নিতে পারেন। এর বাইরেও যদি দরকার হয় ছুটির বিধান আছে। ছুটির বিধানে নারী ও পুরুষের জন্য প্রায় সমান সুযোগ থাকায় চাকরি করার ক্ষেত্রে নারীদের আলাদা করে কোনো বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে না। এর বাইরে সরকার নিজেই শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরি করে দিয়েছে। বাবা-মা তার জন্য টাকা খরচ করলেও সন্তানকে নিয়ে বাড়তি কোনো চিন্তা করতে হচ্ছে না। আর এ ধরনের সুযোগ থাকার ফলেই দেশটির প্রায় ৭০ শতাংশ নারী বাইরে কাজের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে এক পুলিশ স্টেশনে গেলাম। আরে, এখানে তো দেখি বেশির ভাগ পুলিশই নারী। এখানে নারীদের গড় আয়ু বেশি।
ডেনমার্কে প্রায় ছয় বছরের বেশি সময় ধরে প্রবাসী বাংলাদেশি মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জানালেন, এখানে শিশুর প্রতিটি বিষয় খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়। ঘরের তাপমাত্রা পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়, যদি দেখা যায় তাপমাত্রা শিশুর জন্য ক্ষতিকর, তখন ওই শিশুকেই নিয়ে নেয় তারা। আর বাবা-মা চাইলেই বাইরে বেশি কাজ করতে পারবেন না। সপ্তাহের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা আছে। কেউ বেকার হয়ে গেলে সরকার দীর্ঘ সময় ওই ব্যক্তির পাশে থাকছে। এখানে আরেকটা জিনিস ফ্রি, তা হলো মানুষের মুখের হাসি। কামরুল ইসলাম জানালেন, এত দিনের মধ্যে এখানে কোনো নারী ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে শুনেছেন তা তাঁর মনেই পড়ছে না। কামরুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন নাহার দুই বছর ধরে কোপেনহেগেনে আছেন। কাজের পাশাপাশি দেশটির ভাষা শিখছেন আরও ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
জেবুন নাহার বললেন, ‘আমি এখানে এত দিন ধরে আছি, শুধু মেয়ে বলে কোনো বৈষম্যের শিকার হইনি। রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় আজ পর্যন্ত কোনো বাজে মন্তব্য শুনিনি।’
এখানকার মানুষজন এত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে বলেই চলতি বছরের ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’-এ দেশটি প্রথম হয়েছে। দেশটি এখন সবচেয়ে ‘হ্যাপিয়েস্ট’ দেশ। আর বাংলাদেশ ১৫৭টি দেশের মধ্যে হয়েছে ১১০তম।