গরিবের ঈদ স্মৃতি

সেই দিনের ঈদটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তবে আমি জন্মের পরের কয়েকটা ঈদ অবশ্য আমার মনে নেই। তবে, বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে ঈদের স্মৃতিটুকু মনে আছে। আমরা খুবই গরিব পরিবারের সন্তান। মনে পড়ে কারও পুরোনো কাপড়গুলোই আমাদের মতো গরিবদের নতুন কাপড়। যখন ছোট ছিলাম তখন ঈদ আনন্দ বলতে বুঝতাম নতুন কাপড় পাওয়া ও বড়দের থেকে ঈদ সালামি পাওয়া। নতুন কাপড় বলতে হয় সেটা কারও দেওয়া পুরোনো বা রাস্তার হকার থেকে সস্তায় কেনা কাপড়।

এখন তো বড় হয়েছি। বাবা মা অনেক কষ্ট করে ও আমি টিউশনি করে কোনোমতে এইচএসসি পাশ করেছি। কিন্তু যখন বিপদ আসে দল বেঁধে আসে। এবারের ঈদটা সম্পূর্ণ আলাদা। রমজানের আগে আমার ছোট ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে সহায় সম্পদ বলতে যা আছে, সেখান থেকেই কিছু বিক্রি করে এবং ধার-দেনা করে চিকিৎসা করে। কিন্তু এবার ঈদটা নিয়ে চিন্তা বেড়ে গেল। ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে এল টেনশনটা ততই বাড়তে লাগল। আমি জানি, যেখানে একবেলা খাবার জোগাড় করতে কষ্ট হয়, সেখানে নতুন কাপড় পাওয়া কষ্টকর। কারণ তাদের কাছে দেওয়ার মতো কোনো টাকা নেই। আমরা গরিব, আমাদের জন্য ঈদ বলতে কিছু নেই। যখন ছোট ছিলাম তখন ভালোমন্দ বুঝতাম না। যা জুটতো তা নিয়েই আনন্দ করতাম। কিন্তু এখন বড় হয়েছি, কিছু করতে হলে ভেবে চিন্তে করতে হয়। হুট করে কোনো কিছু করা যায় না!
সেবার ঈদের নামাজ পড়া হয়নি। সারা দিন শুয়ে ছিলাম। নতুন কাপড়ের অভাবে লোকলজ্জার ভয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যাইনি। কারণ আমার এলাকার কিছু হিংসুটে বন্ধু লজ্জা দেবে এই ভেবে। পকেটে একটা টাকাও নেই। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। আমার কয়েকজন চাচাতো ভাই ও বোন এসে তাদের সঙ্গে তাদের বাড়িতে সেমাই খেতে নিয়ে গেল। কোনোমতে তারা যেন বুঝতে না পারে, মোটামুটি একটা কাপড় পড়ে তাদের সঙ্গে চললাম। আমার বাবার এক চাচাতো ভাই অর্থাৎ আমার এক চাচা খুবই বড় লোক। তাঁর বাড়িতে যাওয়ামাত্র ওই চাচা তিনজনকে ঈদ সালামি বাবদ নতুন ৫০০ টাকার নোট দিল, কিন্তু আমাকে ও আরেকজনকে দিল না। ব্যাপারটা বুঝলাম না। মনে হলো, ওই মুহূর্তে মরে যাওয়ার চেয়ে শান্তির কিছু হতে পারে না। নিজের প্রতি খুব অপমান বোধ হলো। এই অপমান সামাল দিতে খুব কষ্ট হলো। কেউ যেন টের না পায় তাই এক ফাঁকে টয়লেটে যাওয়ার ভান করে চলে এলাম বাড়িতে। নিজের রুমে ঢুকে খুব কাঁদলাম। আমি ও আমার যে গরিব চাচাতো ভাই ঈদ সালামি পাইনি, দুজনের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু ঈদ সালামি পাওয়া বাকিদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো। সুতরাং, আমরা ঈদ সালামি পাওয়ার যোগ্য ছিলাম না।

গরিব হয়ে জন্ম নিয়ে, পাওয়ার চাইতে বেশি কিছু আশা করাটা নেহাত দুঃস্বপ্ন। কিন্তু যাদের আছে তারা পেতেই থাকে। এটাই জগৎ সংসারের বাস্তবতা।