গল্প লেখাও যে পেশা হতে পারে, এটা কখনো ভাবনাতে ছিল না
তানজানিয়ার ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জেতেন। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে লেখকজীবন নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
‘ঈশপের গল্প’ দিয়ে শুরু
আমি গল্প খুব ভালোবাসি। ছোটবেলায় সবার মুখ থেকে গল্প শুনতে শুনতে আমার ভেতর গল্প পড়া আর লেখার প্রতি ভালোবাসা জন্মে। এরপর যখন পড়তে শিখি, আমার হাতে তুলে দেওয়া হয় ঈশপের গল্প, অবশ্যই সোয়াহিলি ভাষায় অনূদিত। একটা শেয়াল লোভাতুর দৃষ্টিতে আঙুরের দিকে তাকিয়ে আছে—সেই ছবিটা এখনো আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে। আমি জানি, আমার মতো অনেকের জীবনেরই প্রথম পড়া গল্পের বই এটা। আমি তানজানিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছি। বেড়ে ওঠার সময় আমার পরিবারের মা-খালা-ফুফু-দাদি-নানিদের মুখে গল্প শুনে প্রথমে কল্পনার জগতে পা রাখি। কিন্তু যখন থেকে পড়তে শুরু করলাম, তখন থেকে যেন আমার পৃথিবীটা বড় হয়ে গেল।
পড়তে শুরু করা বলতে কিন্তু স্কুলের পাঠ্যবই পড়া নয়। ওই পড়া তো অনেক সময় মন থেকে করা হয় না, বারবার পড়ে মুখস্থ করার জন্য শুধু মাথায় ঢোকানো হয়। আমি বলছি, মন থেকে পড়ার কথা। আমি দেখেছি, বাচ্চাদের একটা বই ভালো লেগে গেলে ওরা তা ২০ থেকে ৩০ বার পড়েও ক্লান্ত হয় না। আমিও সেভাবে আমার কাছে থাকা প্রতিটি বই পড়তাম। আর এভাবেই বেড়ে উঠতে উঠতে পড়া আর লেখার প্রতি ভালোবাসাটাও বেড়ে ওঠে। মনের ভেতর ঢুকে যায় বই পড়ে সব অজানাকে জানার আগ্রহ। আর এখন সেই আগ্রহই অভ্যাসে বদলে গেছে, যে অভ্যাস আমাকে প্রতিনিয়ত পরিপূর্ণ করে, তৃপ্ত করে।
গল্প ও ছেলেবেলা
শিশুরা ছেলেবেলায় যে গল্পগুলো শোনে আর পড়ে, সেগুলো তাদের পরবর্তী জীবনে বেশ প্রভাব ফেলে। আমরা হয়তো এক সময় ছেলেবেলার সেই গল্পগুলো মনে রাখি না কিন্তু গল্পের ভেতরে থাকা বার্তা আর শিক্ষাগুলো ঠিকই কিন্তু বয়ে বেড়াই আজীবন। নানা সময়ে ছেলেবেলার গল্পগুলোকে আমরা নানাভাবে আবিষ্কার করি।
বাচ্চারা নিজের চারপাশ থেকে নিজের অনুপ্রেরণা খুঁজে নেয়। কেউ ট্রেন দেখে বলে, বড় হয়ে আমি ট্রেনচালক হব। কম্পিউটার দেখে বলে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হব। কিন্তু গল্প লেখাও যে পেশা হতে পারে, এটা কখনো আমার ভাবনাতেই ছিল না। কারণ বেড়ে ওঠার সময়টাতে এমন কাউকেই দেখিনি, যিনি শুধু লেখালেখি করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অন্তত আমার সময়ে তো এমনটা দুর্লভই ছিল। তাই বড় হয়ে লেখক হব, এমনভাবে চিন্তা কখনোই করিনি। নভোচারী হব, চাঁদ দেখে দেখে শৈশবে এটা ভাবতে পারতাম। কিন্তু লেখক হব—এটা চিন্তার বাইরে ছিল!
তবে হ্যাঁ, আমি স্কুলে যাওয়া খুব উপভোগ করতাম। বই পড়ে নতুন কিছু শেখা ছিল আমার অ্যাডভেঞ্চার। আমি চাইতাম, বড় হয়ে এভাবেই নতুন বিষয় শেখার চর্চা চালিয়ে যাব। মোট কথা, আজীবন ছাত্র হয়ে থাকার স্বপ্ন ছিল আমার। সেই স্বপ্নের তাড়নাতেই আজ হয়তো লেখক হয়েছি। কারণ, প্রতিবার নতুন কিছু লেখার সময় কত কত নতুন কিছু শিখতে পারি। শেখার আনন্দ আমাকে এখনো রোমাঞ্চিত করে।
লেখক হওয়ার পেছনে আমার শৈশব কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আমি আগে উপলব্ধি করিনি। যখন তানজানিয়া থেকে ব্রিটেনের মতো অপরিচিত এক দেশে এসে স্থায়ী হলাম, তখন থেকেই নিজের পরিচয়, নিজের ছেলেবেলার গুরুত্ব টের পেতে শুরু করলাম। বুঝতে পারলাম, দূরে সরে গেলেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে আরও গভীরভাবে অনুভব করা যায়।
লেখকের অনুপ্রেরণা
আমার দেখা ও আমার আন্দোলিত করার মতো বিষয়গুলো লেখার সুযোগ পেলে আমি ভীষণ অনুপ্রাণিত হই। ‘আমার দেখা বিষয়’ আবার এমন নয় যে চোখ দিয়ে কিছু দেখলাম আর লিখলাম। বোঝাতে চেয়েছি, যে বিষয়গুলো আমার চিন্তার জগৎকে জাগিয়ে রাখে—সেই বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে পারার স্বাধীনতাটাই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। কারণ, আমি আমার গল্প দিয়ে আমার দর্শনকে তুলে ধরি, সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলি।
তরুণ লেখদের জন্য একটা উপদেশই আমি দিতে চাই, আপনারা লিখে যান। সফল লেখক হওয়ার এটাই একমাত্র সহজ উপায়। লেখক হওয়ার জন্য দিনে তিনবার করে মাথা চাপড়ে, রাত জেগে দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। লেখা শুরু করুন, প্রতিদিন লেখার চর্চার করুন। লেখক হওয়ার জন্য লেখার কোনো বিকল্প নেই। এখন হয়তো পরিস্থিতির কারণে ভিন্ন কোনো পেশা নিয়েছেন, হয়তো এখনো নিজের তাড়নাকে উপলব্ধি করতে পারছেন না। কিন্তু লেখক হওয়ার তাড়না থাকলে, আর লেখালেখি একবার শুরু করতে পারলে ভুল পথে আপনাকে বেশি দিন হাঁটতে হবে না। একবার চর্চা শুরু করুন, লক্ষ্য আপনার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে।
অবসরে…
ক্রিকেট খুব ভালোবাসি। খেলা দেখতে ভালো লাগে। এ ছাড়া অবসরে নিজের বাগানে সময় দিই। রাঁধতে পছন্দ করি। অবসরে আর সবার মতো গান শুনি, প্রচুর বই পড়ি। কিন্তু নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকে খুব একটা অবসর পাচ্ছি না।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিঃসন্দেহে এক বিরাট ব্যাপার। এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ আমার ব্যাপারে, আমার কাজের ব্যাপারে জানতে চায়, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়—এ আমার জন্য এক দারুণ অর্জন। পাশাপাশি এমন সব প্রকাশকেরা এখন আমার লেখা বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ করতে চান, যাঁরা এত দিন আমার লেখা ছাপতেন না, অনেকে আমাকে হয়তো চিনতেনই না। এর বাইরে নোবেল পাওয়ার পর জীবন কীভাবে বদলে গেছে, তা ভেবে দেখার মতো সময়ই পাচ্ছি না। কারণ, আমাকে প্রতিনিয়ত কথা বলেই যেতে হচ্ছে! ভাবার সময় তো পাচ্ছিই না, লেখার সময়ও পর্যাপ্ত পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যা হচ্ছে মন্দ নয়। জানি, নোবেল পুরস্কার জয়ের এই রেশ হয়তো অল্প কয়েক দিনের মধ্যে কেটে যাবে। এরপর আবার লেখালেখিতে ফিরে যাব, আবার গল্পের জগতে ফিরে যাব।