গাছের মেলায় কিছুক্ষণ

রাজধানীর বৃক্ষমেলায় আছে ঘরে রাখার এমন রঙিন ক্যাকটাস। ছবি: নকশা
রাজধানীর বৃক্ষমেলায় আছে ঘরে রাখার এমন রঙিন ক্যাকটাস। ছবি: নকশা

চলুন তো দেখে আসি, কেমন হয় সাদা চিতা, কালো চিতা আর নীল চিতা। কোথায়? না এর জন্য গভীর অরণ্যে যেতে হবে না। এবারের বৃক্ষমেলায় গেলেই চলবে। এ সবই গাছের নাম। বিচিত্র ফুল-ফল-ঔষধি আর শোভাবর্ধনকারী গাছের মেলা বসেছে রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ে—বাণিজ্য মেলার মাঠে। শুধু ঢাকাই নয়, দূরদূরান্ত থেকে আসা বৃক্ষপ্রেমীর সমাগমও হচ্ছে রোজ। এই বৃক্ষমেলা ১ জুন থেকে চলছে। চলবে ১৫ জুলাই পর্যন্ত।

মেলায় নতুন যা মিলছে
দেশি ফলের গাছের সমাহার
গতবারের চেয়ে ডালভর্তি ফলসহ দেশি গাছের উপস্থিতি নজরে আসছে খুব। চারা তো নয়, যেন আস্ত ফলের গাছ। ড্রামে লাগানো ইয়া বিশাল আকারের লটকনগাছে লটকন লটকে আছে। মাথা তুলে তাকাতে হয় পুরো গাছ দেখতে। দাম হাঁকছে দোকানি ২৫ হাজার টাকা। তবে এর চেয়ে কম দামে ছোট আকারের ফলন্ত লটকনগাছও পাবেন মেলায়। আছে ফলসহ ড্রামে লাগানো বিশাল আকারের জামগাছ—দাম ১২ হাজার টাকা। এর পরই সংখ্যায় অধিক হারে চোখে পড়ছে দেশি ফল ডেউয়া। হলদেটে পাকা ফলের ভারে নুয়ে পড়ার জোগাড়, এমন গাছের দাম পড়বে ১৫ হাজার টাকা। তবে কাঁচা ফলসহ ও ফল ছাড়া ডেউয়ার চারাও পাবেন কিনতে। আছে ফলন্ত তুঁত ফলগাছ—টক-মিষ্টি-রসাল তুঁত ফল ঝুলছে গাছের ডাল থেকে। দাম পড়বে পাঁচ হাজার টাকা। আছে দেশি গাব, এমনকি ফলন্ত বিলেতি গাবও। আছে টবে লাগানো ছোট-বড় বিভিন্ন জাতের আনারসগাছ। কাঁচা ও পাকা—দুই আনারসই চোখে পড়ছে টবের গাছে। আরও মজার ব্যাপার হলো স্ট্রবেরি কিংবা লিচুর সমান পুঁচকে আনারসের দেখাও পাবেন মেলায়। মূলত বাগানের শোভাবর্ধনকারী গাছ হিসেবেই লাগানো হয় দেশের বাইরে থেকে আনা এমন পুঁচকে আনারস।

লেবুর জাতের রকমফের
হাতের আঙুলের মতো কাঠামোর কিম্ভূতকিমাকার লেবু, নাম তার ফিঙ্গার লেবু। গত বছর একটিমাত্র গাছ ছিল, দামও ছিল অনেক—১২ হাজার টাকা। এবার অনেক ফিঙ্গার লেবুগাছ এসেছে। বিচিত্র এই লেবুর দামও তাই কমেছে, নেওয়া যাবে পাঁচ হাজার টাকার ভেতরে। এ ছাড়া আছে কাগজি লেবু, কলম্বো লেবু, হাজারি লেবু, কাঁটাহীন সিলেটি মোম লেবু ও বীজহীন লেবু।

ডোরাকাটা বিচিত্র ফুল-ফল
হ্যাঁ, ডোরা ডোরা দাগকাটা বিচিত্র ফুল-ফলের দেখাও মিলবে মেলায়। গাছের পাতা যেমন ডোরাকাটা, ফলও ঠিক তেমনই ডোরাকাটা। এই তালিকায় আছে ভেরিগেট মাল্টা, লেবু, পেয়ারা, কাসাবা বা শিমুল আলু। শিমুল আলুগাছের পাতা অনেকটা শিমুল মানে তুলাগাছের পাতার মতো, তাই লোকে একে তুলাগাছের চারা বলে ভুল করছেন। পাতাবাহারের মাঝে আছে ভেরিগেট চায়না বাঁশ, লাকি ব্যাম্বু। আর ভেরিগেট জবা, গন্ধরাজ, কাঠগোলাপ ফুলের নজরকাড়া রূপে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।

রঙিন ফুলের আস্তানা
প্রায় প্রতিটি স্টলেই রয়েছে দেশি-বিদেশি নানান রং-বেরঙের ফুল আর শোভাবর্ধনকারী গাছের উপস্থিতি। অনেক রঙের বাহারি জবা থেকে শুরু করে গোলাপ, রঙ্গন, হাসনাহেনা, মোসেন্ডা, এক থোকা হরেক রঙের লেন্টেনা, বাগানবিলাস, হলুদ আলামন্ডা, দাঁতরাঙা, কাঁটামুকুট, ধবধবে সাদা সুগন্ধি জুঁই, টকটকে লাল-গোলাপি ফুরুস ফুল, কুঞ্জলতা, পলাশ, জারবেরা, জিনিয়া, পিস লিলি, দেশি গাব, বিলেতি গাব, ডেউয়া, আলুবোখারা, কাঁঠালচাপা, চায়নিজ টগরসহ আরও অনেক প্রজাতি। আবার এক গাছেই অনেক জাতের ফুল, এমন জবাগাছের দেখাও পাবেন মেলায়। এমন তিন-চারটি রঙের একটি জবাগাছের দাম পড়ছে ছয় হাজার টাকা।

শোভাবর্ধনকারী গাছ
শোভাবর্ধনকারী গাছের মধ্যে লাকি ব্যাম্বু, মানি প্ল্যান্ট থেকে শুরু করে মিলছে পাম কিং, বার্ড নেস্ট, চীনা বাঁশ, কলসি বাঁশ, সমুদ্রসৈকতের ঝাউগাছ পর্যন্ত। বাড়তি আকর্ষণ থাকছে মাটি ছাড়া জন্মানো ঝুলন্ত শিকড় ও ফুলপ্রধান অর্কিডেরও। ফুল ফুটন্ত অর্কিডের পাশাপাশি ছোট চারা, এমনকি বোতলবন্দী টিস্যু কালচারের চারাও বিক্রি হচ্ছে মেলায়। দাম পড়বে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। থাইল্যান্ড থেকে আনা ৬০ বছর বয়সী শোভাবর্ধনকারী গাছ ‘নলিনী পাম’, দোকানি যার দাম চাচ্ছেন তিন লাখ টাকা। দেখা মিলবে মেলার হোসেন নার্সারিতে।

ক্যাকটাস
লাল ও হলুদ গ্রাফটিং করাসহ মেলায় রয়েছে প্রায় ৫০ প্রজাতির ক্যাকটাস। আকার ভেদে ছোট-বড় ক্যাকটাস পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। সবচেয়ে বড় যে ক্যাকটাস দেখে সবার অবাক হতে হয়, নাম তার ব্যারেল ক্যাকটাস। দাম চাওয়া হচ্ছে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকা!

বাহারি বনসাই
দেশি বট, চায়না বট, চন্দন বট, জিনসেন, কামিনী, নাকাসুয়া অশ্বত্থ বট, পাকুড় বট, কতবেল, দেবদারু, পলাশ, বাবলা, শেওড়া, নিম, অর্জুন, পাইফোড়, ফাইকাস, মিরিজুয়া, তেঁতুলসহ কত-কি বনসাইয়ের দেখা মিলবে মেলায়। প্রকার ভেদে এর দাম পড়বে ১ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা।

শাপলা-পদ্ম
জলজ উদ্ভিদের মাঝে রয়েছে বিশাল আকৃতির গোলাকার পাতা নিয়ে আমাজন লিলি, পদ্ম রয়েছে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও বলধা গার্ডেনের স্টলে, তবে তা শুধু প্রদর্শনীর জন্য। কিন্তু এর বাইরে মেলার অন্যান্য স্টলেও এবার শাপলা ও পদ্মের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। জাতীয় ফুল সাদা শাপলা যেমন আছে, আছে লাল আর দৃষ্টিনন্দন বেগুনি রঙের শাপলাও। দাম পড়বে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত।

গাছ-পাখির এই মিলনমেলা
গোলাকার লোহার খাঁচাবন্দী কামিনী ফুলের গাছ, যেন একখান গ্লোব! একটু কাছে যেতেই পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে চমকে উঠতে হয়। খাঁচার ভেতরেই কামিনীর ডালে চক্কর দিচ্ছে আর কিচিরমিচিরে আকর্ষণ কাড়ছে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের। গাছ-পাখির এই মিলনমেলা নিতে চাইলে গুনতে হবে ২৫ হাজার টাকা।

ছাদে বাগান করতে প্রশিক্ষণ
ইট কংক্রিটের নগরে ছাদবাগানই এখন ভরসা। ছাদে বাগান করা জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় ছাদে বাগান করতে প্রশিক্ষণও চালু হয়েছে সম্প্রতি। বারিধারার উন্নয়ন সংস্থা ‘লাইফ টু নেচার’ ছাদে বাগান করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ ছাড়া অনলাইনে ছাদে বাগানের ওপর কার্যকর কলাকৌশল ও দিকনির্দেশনাও দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এখানকার সমন্বয়ক হোসনে আরা খানম ও কামরুন নাহার বিনা জানান, ছাদে বাগানের ক্ষেত্রে একেক ধরনের গাছের জন্য একেক রকম যত্ন প্রয়োজন পড়ে। রয়েছে কিছু প্রতিবন্ধকতাও। সেসব কাটিয়ে উঠে সফল ছাদবাগানের জন্যই এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।

বরাবরের মতো যা থাকছে মেলায়
মেলায় প্রবেশ করতেই হাতের বামে প্রথমে পড়বে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও বলধা গার্ডেনের স্টল। রয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দুর্লভ সব ফুল-ফল-ঔষধি বৃক্ষ আর বনসাইয়ের সমাহার। দুর্লভ ও বিপন্ন প্রজাতির ফল প্রদর্শনীতে রয়েছে ডুগডুগি, বরুন, উদয় পদ্ম, বিক্সা, সাইকাস, এরেকা পাম, বক্স বাদাম, গাব, বিলাতি গাব, কেয়া ফল, চাল মুগরা, পালং, নাগেশ্বর। আছে চালতা, কফি, তমাল, পুন্নাল, কাঁঠালচাঁপা, বহেরা, গোসৌভিয়া, ডুমুর, দেবদারু, তসবি, সাইকাস, কলকি ফল, মাকাল ফল, গোঁড়া নিম, অশোক, ডেফল, নাগলিঙ্গম ফল, পান্থপাদব ইত্যাদি। গাছের মধ্যে আছে ভুঁই কদম, ছাতিম, আগর, শ্বেত চন্দন, বার্মা শিমুল তুলা, ঢোল সমুদ্র, রামধাম চাঁপা, উলট কম্বল, বামন হট্রি, বার্ড নেস্ট, বিষ জারুল, পানবিলাস, নীল চিতা, হলুদ চিতাসহ বিচিত্র ও দুর্লভ সব গাছের উপস্থিতি।
মেলা ঘুরে ঘুরে দর্শনার্থীরা ডালভর্তি ফল গাছ দেখছেন আর বিস্ময়ে অবাক হচ্ছেন। ফলের সঙ্গে সেলফি তুলছেন। তাতেও তৃপ্তি না মিটলে কিনে নিচ্ছেন ঝটপট। এমন সব ডালভর্তি ফল গাছের মধ্যে রয়েছে আম, জাম, কাঁঠাল, কাঠলিচু, কমলা, নাগপুরি কমলা, মাল্টা, আমলকী, আমড়া, বেল, সফেদা, থাই লম্বাটে সফেদা, থাই লাল শরিফা, থাই ডুমুর, থাই ড্রাগন, থাই করমচা, পেয়ারা, আকারে ছোট চায়না লাল পেয়ারা, কুল, ডালিম, আনার, জামরুল, ফিলিপাইনের মিষ্টি চালতা, জাম্বুরা, লেবুসহ রয়েছে শতাধিক জাতের চারা।
বারোমাসি ফলের মধ্যে আম, আতা, আনার, পেঁপে, কলা, বিলুম্ব থেকে শুরু করে কলমের বারোমাসি কাঁঠালের চারাও মিলছে মেলায়। মসলাজাতীয় উদ্ভিদের মধ্যে পাবেন আদা, আম আদা, লেমন গ্রাস, হলুদ, দারুচিনি, ছোট ও বড় এলাচি, তেজপাতা, লবঙ্গ, কারি পাতা, পোলাও পাতা, পুদিনা ইত্যাদি। ঔষধি বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে অশ্বগন্ধা, সর্পগন্ধা, কালো ধুতরা, হরীতকী, নিম, নিসিন্দা, পানবাহার, থানকুনি, শালপানি, শতমূলী, লজ্জাবতী, তুলসী, রাম তুলসী, সোনালু, কাজু বাদাম, দণ্ডকলস, মটকিলা, হাড়জোড়া, অপরাজিতা, লেমন গ্রাস, ঘৃতকুমারী, নীল, শিবজটা, বড় কালকেসুন্দা, সূর্যকন্যা, নাগমণি, চন্দন, অর্জুন, বাসকসহ প্রায় ৩০ প্রজাতির চারা।
আছে পান, সুপারি আর সৌদি খেজুরের সংগ্রহও। পলি ব্যাগের ছোট চারা থেকে ড্রামভর্তি বড় সৌদি খেজুর চারার দাম পড়বে ৫০০ থেকে ১ লাখ টাকা।

অন্যান্য
শুধু চারাই নয়, চারা লাগানোর বিভিন্ন আকারের বাঁশ-বেত, মাটি ও প্লাস্টিক টবের স্টলও আছে মেলায়। উপযুক্ত মাটি থেকে শুরু করে মিলছে বিভিন্ন ধরনের জৈব ও রাসায়নিক সার, কীটনাশক, গ্রোথ হরমোন। উন্নত জাতের ফল ও সবজির প্যাকেটজাত বীজ। বাগান পরিচর্যার বিভিন্ন সরঞ্জাম ও কৃষিবিষয়ক বই ও দিকনির্দেশনা সংবলিত লিফলেট। আছে রাবারগাছের তৈরি আসবাবপত্রের প্রদর্শনীও। মেলায় ৭৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে অংশ নেওয়া মোট স্টলের সংখ্যা ১০০।