গৌতমের চোখে শাকিলের এগিয়ে চলা

গৌতম কুমার ও শাকিল হোসেনের বন্ধুত্বের গল্প রাজশাহী শহরের অনেকেরই জানা। একজনের চোখে আলো নেই; তাতে কি, অন্যজনের চোখ আছে না! তাঁদের বন্ধুত্বের আরও গল্প শুনুন এখানে

গৌতমকে (ডানে) ছাড়া শাকিলের চলে না
ছবি: সংগৃহীত

২০১৬ সালের মে মাসের কথা। শাকিল হোসেনের সিট হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে। আর গৌতম কুমারের শাহ্‌ মখদুম হলে। কিন্ত গোঁ ধরে বসলেন শাকিল। অন্য হলে সিট হলেও গৌতমকে তাঁর কাছে থাকতে দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত তাঁর দাবি মেনে নিয়ে দুই বন্ধুকে এক হলে থাকতে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শাকিল দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। শাকিল নামাজে গেলে গৌতম তাঁকে মসজিদে পৌঁছে দিয়ে বাইরে বসে থাকেন। শাকিল রোজা রাখলে সাহ্‌রি এনে দেন গৌতম। গৌতম পড়েন, শাকিল শুনে মুখস্থ করেন। মুঠোফোনে পাঠ্যবই রেকর্ড করে দেন। এককথায় গৌতমকে ছাড়া শাকিলের চলে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবার স্নাতকোত্তর শেষ করলেন দুই বন্ধু।

নওগাঁয় তাঁদের বাড়ি

শাকিল হোসেনের বাড়ি নওগাঁ সদর থানার বক্তারপুর ইউনিয়নের হরিহরপুর গ্রামে। গৌতম কুমারের বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে। শাকিল হোসেন ও গৌতম কুমার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ২০১৪ সালে। শাকিল হোসেনের চোখে আলো নেই। তাঁর মা শামীমা ইয়াসমিন রাজশাহী শহরে থাকেন। ছেলের ক্লাস শেষ হওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মমতাজ উদ্দিন কলা ভবনের পশ্চিম পাশে ইবলিস চত্বরে অপেক্ষা করেন। ২০১৫ সালের ৩ মার্চ মায়ের আসতে দেরি হচ্ছিল। তখন গৌতম এসে নিজে থেকে পরিচয় দিয়ে বলেছিল, ‘আমি তোমার সঙ্গেই পড়ি। আমার বাড়িও নওগাঁ। চল আমি তোমাকে পৌঁছে দিই।’

সেই থেকে দুজনের একসঙ্গে পথচলা। দুষ্টুমি করে গৌতমকে ‘গোপাল’ বলে ডাকেন শাকিল। আর গৌতম তাঁকে ‘বিষ্ণু’ বলে ডাকেন।

প্রতি মঙ্গল ও শুক্রবার নগরের ষষ্ঠিতলায় এক সংগীত শিক্ষকের বাসায় তালিম নেন শাকিল। রবীন্দ্র, নজরুল ও উচ্চাঙ্গসংগীতের ওপরে তার ভালো দখল। রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমি থেকে সংগীতের ওপরে চার বছরের ডিপ্লোমা করে নিয়েছেন। রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড করেছেন। রোভার স্কাউটের সহচর, সদস্য, প্রশিক্ষণ ও সেবা স্তর রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি এই চারটি স্তরই সম্পন্ন করেন। বাংলাদেশে আর কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এই স্তর পর্যন্ত গেছেন কি-না তা জানা যায়নি। শাকিল বলেন, ‘গৌতম ছাড়া এটা সম্ভব হতো না।’

তবে তাদের মান-অভিমানও হয়। মান ভাঙানোর জন্য গৌতমই আগে কথা বলেন। শ্রুতলেখকের ব্যবস্থা করে দিতেন গৌতম। ইনকোর্স পরীক্ষা বা ক্লাস টেস্টের সিংহভাগ শ্রুতলেখক ছিলেন দীপক চন্দ্র। একই সেশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র তিনি। নওগাঁর নিয়ামতপুর এলাকায় তাঁর বাড়ি। তিনি বলেন, ‘গৌতম যা করেছে, আমি তা কল্পনাও করতে পারি না। ক্লাস শেষে আমরা হয়তো একটু ঘুরতে যাই। গৌতম তখন শাকিলকে সময় দেয়। এমন বন্ধুত্বের নজির আর কোথাও দেখিনি।’

রাজশাহী নগরের কাজলায় ছোট্ট একটি বাসায় মাকে নিয়ে থাকেন গৌতম। মা সেলাইয়ের কাজ করে যে আয় করেন, তা দিয়েই ছেলের পড়াশোনার খরচ চালান।

ফেরার সময় গান শুনতে চাইলে শাকিল হারমোনিয়াম ধরে গলা ছেড়ে গাইলেন, ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন...।’