চাকরি ছেড়ে ‘কিষানি’ রাজশাহীর আফসানা

আফসানা আকতার
ছবি: শহীদুল ইসলাম

কথা হয়েছিল রাজশাহীর বাণিজ্য মেলায়। চায়ে চুমুক দিতে দিতে। তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর কিষাণীতে যা বিক্রি হচ্ছে, সবই প্রাকৃতিক। মধু দেখিয়ে বললেন, ‘এটাও চাষের নয়। বনবাদাড়ে মৌমাছি যে চাক তৈরি করে, সেখান থেকেই সংগ্রহ করি।’

সেদিনই বলেছিলাম, পরবর্তী যেদিন মধু আহরণ করা হবে, যেন ডাক পাই। কয়েক দিন পর সত্যিই তাঁর ফোন, মধু আহরণ চলছে রাজশাহী নগরের কাজীহাটা এলাকার পিটুলিগাছে (গোটাগামার নামেও পরিচিত)। গিয়ে দেখা গেল কিষাণীর নিজস্ব মৌয়াল। তাঁরাই ভাঙছেন মৌচাক। আর কিষাণী প্রতিষ্ঠানটি যিনি গড়েছেন, সেই আফসানা আকতার বাণিজ্য মেলায় যে মাথাল পরে ছিলেন, সেখানেও সেই মাথাল।

আফসানা আকতার কাছের মানুষের কাছে আশা নামে পরিচিত। নামের মতো তাঁর আশাও অনেক বড়। মানুষকে খাঁটি জিনিস খাওয়াবেন। এই বাসনা থেকে গড়েছেন নিজের প্রতিষ্ঠান কিষাণী। একই নামে ফেসবুকে একটি পেজ খুলেছেন। এই পেজ থেকে আম কিনে খেয়ে সরকারের একজন সাবেক সচিব মন্তব্য লিখেছেন, ‘শৈশব-কৈশোরে আমাদের বাগানের আম খেয়ে বড় হয়েছি। এখন রাস্তাঘাট থেকে কিনে খাই তথাকথিত বিশুদ্ধ আম। কিন্তু স্বাদ-গন্ধ যেন আগের চেনা থেকে আলাদা। নষ্টও হয় বেশ। কিষাণী থেকে আসা আম খেয়ে ফিরে পেলাম আমার আবাল্য পরিচিত স্বাদ। একটিও নষ্ট হয়নি বলে স্বস্তি। ধন্যবাদ কিষাণীকে।’

আফসানার বাসা রাজশাহী নগরের মহিষবাথান এলাকায়। বাবা, মা ও ছোট ভাই আদর আল আইয়ানকে নিয়ে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। সেখান থেকেই তাঁর ব্যবসা পরিচালনা করেন। তাঁর বাড়ি নওগাঁর আত্রাই উপজেলার নন্দীগ্রামে। বাবা আনছার আলী আত্রাইয়ের একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। আফসানা নাটোরের রানি ভবানী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। এর পর থেকেই রাজশাহী শহরে বাস। ২০১৪ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন রাজশাহী কলেজ থেকে।

উদ্যোক্তা হিসেবে এই পেজকে কৃষিপণ্যে সাজাতে গিয়ে নিজেও হয়ে গেছেন পাকা কিষানি। ২০১৬ সালে আম দিয়ে শুরু। এখন পণ্যতালিকায় জায়গা করে নিয়েছে কুমড়াবড়ি, মধু, শর্ষের তেল, ঘি, নারকেল তেল, খুলনার চুইঝাল, শ্রীমঙ্গলের চা-পাতা ও আত্রাইয়ের নন্দীগ্রামের খেজুর গুড়।

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী আফসানা চাকরিও শুরু করেছিলেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। পেশায় খ্যাতিও জুটেছিল, কিন্তু ভালো লাগেনি। হয়েছেন 'কিষানি’।

এ কাজের শুরুটা হয়েছিল প্রিয়জনকে উপহার পাঠানোর শখ থেকে। রাজশাহীর বাইরে থাকা স্বজন ও প্রিয় শিক্ষকদের আম পাঠাতেন আফসানা। একবার এক শিক্ষক পরামর্শ দিলেন, ‘এভাবে হয় না। এর চেয়ে তুমি উদ্যোক্তা হয়ে যাও। আমাদের খাঁটি জিনিস পাঠাও। তোমার ব্যবসা হবে। আমরা ভালো জিনিস খেতে পারব।’ সেই কথা মনে ধরে যায় আফসানার। স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে উদ্যোক্তা হয়ে গেলেন। আমের পাশাপাশি ক্রেতারা চাইলেন কুমড়াবড়ি। তিনি রাজশাহীর পবা উপজেলার দামকুড়া এলাকায় নারীদের একটি দল গঠন করলেন। বসে থেকে তাঁদের কাছ থেকে কুমড়াবড়ি তৈরি করে নেন। ক্রেতারা খেয়ে খুব খুশি।

এরপর এল খেজুর গুড়ের মৌসুম। ক্রেতারা গুড় চায়। এবার নিজ গ্রাম আত্রাই উপজেলার নন্দীগ্রামের গাছিদের সঙ্গে চুক্তি করলেন। দাম যা-ই হোক, আসল গুড় দিতে হবে। আফসানার ভেতরে কোনো হতাশা বাসা বাঁধার সুযোগ পায়নি। বললেন, প্রথম বছরে সাত লাখ টাকার শুধু গুড়ই সরবরাহ করেছেন।

আফসানা কথা বলেন আন্তরিকতা মিশিয়ে। ব্যবসার জন্য এটা খুবই দরকারি। কেউ খেজুর গুড়ের বায়না দিলে তিনি তাঁর সঙ্গে বিনা মূল্য এক প্যাকেট চা-পাতা পাঠিয়ে দেন। পরেরবার দেখা যায় আপনা-আপনি চা-পাতার ফরমাশ পান। ক্রেতারা যা চান, তিনি তা-ই দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা কাঠের ঘানির শর্ষের তেল চাইলেন। আফসানার নিজ গ্রামেই কাঠের ঘানি রয়েছে। শুধু গরুরটা বাদ দিয়ে যন্ত্রচালিত ঘানি ঠিক করলেন। কারণ, গরু দিয়ে ঘানি টানাতে তাঁর খুব খারাপ লাগে। তিনি নিজের জমির শর্ষে ভাঙিয়ে খাঁটি তেলটা নেন।

একইভাবে চাহিদা এল ঘি, নারকেল তেল ও মধুর। খাঁটি ঘি তৈরির জন্য রাজশাহীর বাঘা, আড়ানী ও নাটোরের লালপুরে তিনি কারিগর ঠিক করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে তিনি এক নম্বর ক্রিমটা সংগ্রহ করেন। এই ক্রিমের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়ে গেছে। যখন যেখানে এক নম্বর ক্রিম পান, সেখান থেকেই সংগ্রহ করেন। তা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাসায় বসে ঘি তৈরি করেন। একইভাবে তৈরি করেন নারকেল তেল। চা-পাতা পাঠানোর জন্য শ্রীমঙ্গলে রয়েছে নিজস্ব লোক। খুলনায় একটি দল রয়েছে, তারা নিয়মিত চুইঝাল পাঠায়। আর তিনি রাজশাহীতে বসে সারা দেশে সরবরাহ করেন। এভাবেই এখন তাঁর কিষাণীর নিয়মিত ক্রেতা ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে।

সম্প্রতি রাজশাহী নগরের মহিষবাথান এলাকায় তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাসার দুটি ফ্ল্যাটের একটি শুধুই কিষাণীর পণ্যে ঠাসা। সেখানে একটা চেম্বারও রয়েছে। তাতে ব্যবস্থাপক হিসেবে বসেন ছোট ভাই আদর। আনুষ্ঠানিকভাবে ছোট ভাই ব্যবস্থাপক হলেও কিষানি নিয়ে বাসার সবারই সমান মাতামাতি।

চাকরির আয়ের উৎস অনেকটা নিরাপদ হলেও আফসানা স্বাধীনভাবে এখন ব্যবসাটাই করছেন। ব্যবসার সফলতার ব্যাপারে কতখানি আশাবাদী? আফসানার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, ‘দুই শত ভাগ।’