চাকা পায়ে ৩৭৬ কিলোমিটার!

>ঢাকা থেকে কক্সবাজার ৩৭৬ কিলোমিটারের পথ তাঁরা পাড়ি দিয়েছেন রোলার স্কেটিং করে। তবে শুধু রোলার স্কেটিং নয়, সার্চ স্কেটিং ক্লাবের সদস্যদের এই যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল সমাজ-সচেতনতা তৈরিও। বিস্তারিত জানাচ্ছেন পল্লব মোহাইমেন

‘বাড়ি থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেলে করে আমি আর আমার ভাই জহির বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিলাম। ২০ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। দেখি সারি বেঁধে রাস্তার এক পাশ দিয়ে বড়সড় একটা দল স্কেটিং করে এগিয়ে আসছে। আমি সৌদি আরবে থাকি। সেখানে ছেলেরা এরকম করে স্কেটিং করে দেখেছি। নিজের দেশেও এই দৃশ্য দেখে খুবই ভালো লাগল।’ ২৪ ফেব্রুয়ারি মুঠোফোনে এমনটাই বলছিলেন আবুল কাশেম।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে কক্সবাজার থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দূরত্বে সেদিন স্কেটারদের যে দলটিকে দেখেছিলেন কাশেম, সে দলটি ঢাকার সার্চ স্কেটিং ক্লাবের। ওদের গন্তব্য ছিল কক্সবাজার আর শুরুটা হয়েছিল ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে। দেখা হওয়ার পর কাশেম ও জহির কথা বলেন দলের সদস্যদের সঙ্গে। ‘আমরা তাঁদের বলি কোনো সহযোগিতা লাগবে কি না! পরে তাঁদের নাশতা খাওয়াই। বেশ কিছু দূর সঙ্গে থেকে তাঁদের এগিয়ে দিই।’

সকালবেলা অনুশীলন শুরুর আগে সার্চ স্কেটিং ক্লাবের সদস্যরা। ছবি: প্রথম আলো
সকালবেলা অনুশীলন শুরুর আগে সার্চ স্কেটিং ক্লাবের সদস্যরা। ছবি: প্রথম আলো

দুস্তর যাত্রা
রোলার স্কেটে করে সার্চ স্কেটিং ক্লাবের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল ১২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায়। ঢাকা থেকে কক্সবাজার—৩৭৬ কিলোমিটারের এই দীর্ঘ পথ তাঁরা পাড়ি দেবেন পায়ের চাকায় চেপে, মানে রোলার স্কেটিং করে। খবরটা জানা গিয়েছিল ফেসবুকে তাঁদের ফ্যানপেজ থেকে।
সার্চ স্কেটিং ক্লাবের ২০ জন স্কেটারের এই যাত্রার উদ্দেশ্য নিছকই স্কেটিং দক্ষতা দেখানো নয়। ‘মাদককে না বলুন’—এই স্লোগান নিয়ে মাদকবিরোধী প্রচারণা এবং মাদকের কুফল সম্পর্কে প্রচারণা চালনাই ছিল রোলার স্কেটে ভর করে দূরপাল্লার এই অভিযানের।
২১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে আটটায় কক্সবাজার শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ হয় দূরপাল্লার এই রোলার স্কেটিং। জানা গেল প্রথম আলোর কক্সবাজার প্রতিনিধি আব্দুল কুদ্দুস ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের কক্সবাজার প্রতিনিধি জাফর সারওয়ারের কাছ থেকে।
২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কথা হলো সার্চ স্কেটিং ক্লাবের চেয়ারম্যান আরশাদ আলমের সঙ্গে। ৫২ বছর বয়সী আরশাদ নিজেও এই অভিযানে অংশ নিয়েছেন। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন ২৫ বছরের তরুণ মো. মতিউর রহমান এবং তাঁর দুই ছেলে আরাফাত আলম (১৯) ও আবতাহী আলমকে (১৬)। এই চারজনই ঢাকা-কক্সবাজারের স্কেটিংয়ে ছিলেন এবং পুরোটা পথ স্কেটিং করেছেন। ২০ জনের দলটির মধ্যে ১৪ জনই একইভাবে স্কেটিং করে কক্সবাজার পৌঁছেছিলেন।

জুতার নিচে বিশেষ ধরনের চাকার সহায়তায় কসরত প্রদর্শনের একটি খেলার নাম রোলার স্কেটিং।  ছবি: প্রথম আলো
জুতার নিচে বিশেষ ধরনের চাকার সহায়তায় কসরত প্রদর্শনের একটি খেলার নাম রোলার স্কেটিং। ছবি: প্রথম আলো

পথে যেতে যেতে
পরিকল্পনা ছিল নয় দিনে কক্সবাজার পৌঁছানো। শেষ পর্যন্ত সেটা ১০ দিনে সম্পন্ন হয়। ‘আমাদের সঙ্গে মাদকবিরোধী প্রচারণার জন্য লিফলেট ও স্টিকার ছিল। আরও ছিল ‘‘কার্বনকে না বলুন’’ স্লোগানে পরিবেশদূষণ রোধের স্টিকার। যখনই কোনো রাস্তার মোড়ে যেতাম, আমরা একটু থামতাম। মানুষজন স্কেটিংয়ের দল দেখে ভিড় করত। তখন আমরা মাদকবিরোধী কথা বলতাম এবং লিফলেট ও স্টিকার বিতরণ করতাম।’ বলছিলেন আরশাদ আলম।
ঢাকা, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম হয়ে সার্চ স্কেটিং ক্লাবের স্কেটাররা যান কক্সবাজারে। মতিউর জানালেন, যাত্রাপথে চারটি স্কুল, দুটি কলেজ ও একটি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের সামনে মাদকবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন তাঁরা। ‘চট্টগ্রামের মিরসরাই মারুফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে যেদিন যাই, সেখানে তখন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছিল। আমাদের তাঁরা মঞ্চের একেবারে সামনের সারিতে বসিয়ে দেন। এ রকম আতিথেয়তা অনেক জায়গাতেই পেয়েছি আমরা।’
চলতি পথে সমস্যা বা দুর্ঘটনা? আরাফাত আলম বললেন, ‘পা ফুলে-টুলে যাওয়া ছাড়া তেমন কেনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। এ দলে প্রত্যেকেই ছিল প্রশিক্ষিত, দক্ষ স্কেটার। ট্রাফিক নিয়ম মেনে রাস্তার বাঁদিকে একজনের পেছনে আরেকজন—এভাবে আমরা থাকতাম। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে দ্বিমুখী যান চলাচল, যখন ওভারটেকিং চলছিল তখন আমাদের সমস্যা হতো। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা করেছে উচ্চশব্দের হর্ন।’ দলের সদস্য আবতাহী যোগ করে, ‘এক দিন ৮২ কিলোমিটার স্কেটিং করেছি। সেদিন রাতে আমার পা ফুলে গিয়েছিল। তার পরের দিনই আবার রাস্তায় নেমেছি।’

দাউদকান্দিতে মাদকবিরোধী প্রচারণা
দাউদকান্দিতে মাদকবিরোধী প্রচারণা

স্কেটিংয়ের চেয়ে বেশি কিছু
উচ্চ আওয়াজে হর্ন না বাজানোর আহ্বান জানিয়েও প্রচারণা চালায় সার্চ স্কেটিং ক্লাব—জানালেন আরশাদ আলম। এই স্কেটিং ক্লাবটি রোলার স্কেটিং চর্চা ও খেলার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা তৈরির জন্য নানা কর্মসূচি হাতে নেয়। সে তালিকা কম দীর্ঘ নয়। উচ্চমাত্রার হর্নকে না বলুন, খাদ্যে বিষাক্ত রং ও রাসায়নিককে না বলুন, রমজানসহ সারা বছর ভেজালমুক্ত খাবার চাই, ধূমপানকে না বলুন—এ রকম স্লোগান নিয়ে স্কেটিং করে তাঁরা সচেতনতা তৈরি করে যাচ্ছেন।
‘আমাদের ক্লাবের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ৬০০, এর মধ্যে সক্রিয় ৩০০ জন। মেয়ে আছেন ৪০ জন। ক্লাবের সদস্য হওয়ার প্রধান শর্ত হলো অধূমপায়ী হতে হবে। যদি কেউ আগে ধূমপানে আসক্ত হয়েও থাকেন, তাঁকে আমরা বুঝিয়ে ধূমপান ত্যাগ করাই।’ বললেন আরশাদ আলম। আরও জানালেন, সার্চ স্কেটিং ক্লাবে রোলবল (স্কেটিং করে হ্যান্ডবলের মতো খেলা, প্রতি দলে ছয়জন করে খেলেন) খেলোয়াড় রয়েছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে তাঁরা অংশও নিয়েছেন। আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় জাতীয় রোলবল টুর্নামেন্টেও অংশ নেবে এই ক্লাব।

একজন আরশাদ আলম
আরশাদ আলম স্কেটিংয়ে এসেছেন দুই ছেলের কারণেই। ২০০৭ সালে দুই ছেলেকে রোলার স্কেট কিনে দেন। তাঁদের নিয়ে অনুশীলন করাতে যেতেন। ‘আমার খুব ভালো লাগত।’ ৪৬ বছর বয়সে স্কেটিং শিখে এখন রীতিমতো দক্ষ স্কেটার। সমানে পাল্লা দিয়ে যাচ্ছেন তরুণদের সঙ্গে। প্রথমে চেয়ারম্যান হিসেবে লেজার স্কেটিং ক্লাবে যোগ দেন আরশাদ। পরে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সার্চ স্কেটিং ক্লাব।

মিরসরাই পেরোনোর সময়। ছবি: সার্চ স্কেটিং ক্লাব থেকে সংগৃহীত
মিরসরাই পেরোনোর সময়। ছবি: সার্চ স্কেটিং ক্লাব থেকে সংগৃহীত

সার্চ স্কেটিং ক্লাব
বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের অনুমোদনপ্রাপ্ত ক্লাবগুলোর একটি এই সার্চ স্কেটিং ক্লাব। স্কেটিংয়ের পাশাপাশি তাঁদের সামাজিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ আসিফুল হাসান বললেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের এসব কর্মসূচি আমার খুবই ভালো লাগে। এতে স্কেটিং সম্পর্কে অনেক মানুষ জানতে পারছে। ক্রীড়ার এই শাখার পরিচিতি বাড়ছে। তবে সব কর্মসূচির ব্যাপারে আমাদের আগে থেকে জানালে ভালো হয়, আরও অনেক স্কেটার এতে যুক্ত হতে পারে।’
পেশায় ব্যবসায়ী আরশাদ আলম স্কেটিং ভালোবাসেন, স্কেটিং দিয়ে সমাজের জন্য ভালো কাজ করতে চান। ‘স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ভালো এই স্কেটিং তেমনি পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবেও এটা কাজের। কম দূরত্বে সহজেই রোলার স্কেট চালিয়ে যাতায়াত করা যায়।’
সার্চ স্কেটিং ক্লাবের পরবর্তী পরিকল্পনা আগামী মার্চে ঢাকা থেকে কলকাতা স্কেটিং শোভাযাত্রার আয়োজন করা। আর অবধারিতভাবে সে যাত্রার উদ্দেশ্যও থাকবে সামাজিক কোনো বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। পায়ের নিচে সরষের মতো রূপক নয়, সত্যি সত্যিই পায়ে চাকা লাগিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যেতে চান এই স্কেটাররা!