বেড়ানো
চিতই পিঠার উৎসবে
পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার কুমারখালী গ্রামের কালীমন্দির প্রাঙ্গণে প্রায় ১০০ বছর ধরে হয়ে আসছে চিতই পিঠার উৎসব। কী হয় সে উৎসবে?
বিকেল থেকেই জেঁকে বসেছে কনকনে শীত। ৩১ জানুয়ারি শীতের সে বিকেলে পিরোজপুর থেকে পৌঁছাই নাজিরপুর উপজেলায়। সেখান থেকে আরও ছয় কিলোমিটার পর কুমারখালী গ্রামের শুরু। গ্রামের চক্রবর্তীবাড়ি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলো না। বাড়ির উঠানে গিয়েই চোখে পড়ল কালীমন্দিরটি। মন্দিরের দক্ষিণ প্রান্তে ততক্ষণে শুরু হয়েছে মহা কর্মযজ্ঞ। এ কর্মযজ্ঞ পিঠা বানানোর।
পিঠা বানাতে সারি করে ১০৮টি মাটির চুলা বানানো হয়েছে। প্রতিটি চুলায় তখন রাখা হচ্ছিল মাটির তৈরি সাজ (পাত্র) ও সরা (ঢাকনা)। এই কাজগুলো করছিলেন নারীরা।
সন্ধ্যা নামার মুহূর্তে মানুষ বাড়তে থাকল। তাঁদের কেউ কালীভক্ত, কেউ আসছেন মনোবাসনা পূরণের মানতে, কেউ দর্শনার্থী। পুণ্যার্থীদের কেউ সঙ্গে এনেছেন চালের গুঁড়া, জ্বালানি কাঠ, বাঁশ। সাতটা বাজতেই মন্দিরের পুরোহিত দেবলাল চক্রবর্তী মন্ত্র পাঠ শুরু করলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো উৎসব।
প্রথমে নারীরা চুলায় আগুন ধরিয়ে দিলেন। আগুনের উত্তাপে শীত কিছুটা পালাল। শীতে যাঁরা কাবু হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে চুলার পাশে ভিড় করলেন। মানুষের কোলাহলে মুহূর্তেই মন্দির প্রাঙ্গণ সত্যিকার উৎসবে রূপ নিল।
চালের গুঁড়া আগেই গুলিয়ে রাখা ছিল। নারী পুণ্যার্থীরা পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরপর সরা তুলে সাজ থেকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে খোঁচা দিয়ে পিঠা তুলে পাত্রে রাখছিলেন। কয়েক ঘণ্টা এভাবে চলল পিঠা তৈরির আয়োজন। তৈরি পিঠাগুলো জমিয়ে তা একটা পাত্রে নেওয়া হলো। পাত্রসমেত নেওয়া হলো প্রতিমার ভোগের উদ্দেশ্যে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে পিঠাগুলো প্রসাদ হিসেবে উপস্থিত পুণ্যার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হলো। যাঁরা মনোবাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে এসেছেন, তাঁরা প্রাসাদ হিসেবে বিতরণ করা চিতই পিঠা খেলেন।
ওদিকে থেমে নেই পিঠা বানানোর তোড়জোড়। গভীর রাত পর্যন্ত পিঠা তৈরি চলল। গরম-গরম পিঠা খেলেন আগত লোকজন।
তাঁরা পুণ্যার্থী
চিতই পিঠা তৈরি করতে বসেছিলেন কুমারখালী গ্রামের রিনা রানী দাস। ৫৫ বছর বয়সী রিনা রানী প্রায় ৪০ বছর ধরে কালীমন্দিরের উৎসবে চিতই পিঠা তৈরি করছেন। তিনি কালীভক্ত। দেবতাকে তুষ্ট রাখতে ফি বছর আসেন রিনা রানী। এখন তো সন্তানদের মঙ্গল কামনায় চিতই পিঠা তৈরি করেন তিনি।
বরিশালের উজিরপুরের আনন্দবালার গল্পটা অন্য রকম। জন্মের পর থেকেই মা-বাবার সঙ্গে এখানে আসেন তিনি। সেই ধারা ৭৫ বছর বয়সেও বজায় রেখেছেন। বিভিন্ন সময় পরিবারের সদস্যদেরও সঙ্গে আনেন তিনি। ওদিকে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামের পঙ্কজকান্তি বিয়ে করেছেন ১৬ বছর। তাঁদের সন্তান হচ্ছিল না। গত বছর পিঠা উৎসবে মানত করেছিলেন। বলছিলেন, ‘আমাদের পুত্রসন্তান হয়েছে। সন্তান নিয়ে এ বছর এসেছি।’ তিনি সঙ্গে এনেছেন চিতই পিঠা তৈরির সরঞ্জাম।
শত বছরের উৎসব
এই উৎসবের শুরুটা কীভাবে? জিজ্ঞেস করেছিলাম কালীমন্দিরের পুরোহিত দেবলাল চক্রবর্তীকে। তিনি বলেন, ‘শত বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ হরষিত আনন্দ চক্রবর্তী মাঘের অমাবস্যা তিথিতে কালীমন্দির প্রাঙ্গণে মেলার আয়োজন করতেন। অমাবস্যায় খাবার হিসেবে শুকনা খাবার খাওয়ার রীতি আছে। পরে মন্দির প্রাঙ্গণে চিতই পিঠা তৈরি করে প্রসাদ দেওয়া হতো। মানুষ মনোবাসনা পূরণের জন্য চিতই পিঠা খেতেন। যুগ যুগ ধরে সেটাই চলে আসছে।’
বর্তমানে এখানে পুণ্যার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পিঠা তৈরির আয়োজন উৎসবে রূপ নিয়েছে। চক্রবর্তীবাড়িতে শত বছর আগে ইট-চুন-সুরকির কালীমন্দির ছিল। মন্দিরটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক ভক্ত পাকা ভবন করে দিয়েছেন। বংশপরম্পরায় ১৯৮৬ সালে থেকে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করছেন দেবলাল চক্রবর্তী।
মনোবাসনা পূরণের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হলেও চিতই পিঠা তৈরির এই আয়োজন বর্তমানে উৎসবে রূপ নিয়েছে। এখানে লোকজন মনোবাসনা পূরণের আশায় যেমন আসেন, তেমনি আসেন উৎসবে শামিল হতেও। পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীর মিলন মেলায় হয়ে উঠেছে সর্বজনীন।