
গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা সুন্দর পরিবেশ। শুধু এই পরিবেশের নয়, রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদেরও এলাকায় সুনাম রয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সুস্থ সংস্কৃতিচর্চায় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরাই এ অঞ্চলের তারুণ্যের প্রতিনিধি। স্থানীয় যেকোনো সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে পাশে থাকেন রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা।
ক্যাম্পাসটা ছিমছাম, নিরিবিলি। ক্লাস শেষে কিছুটা হইহুল্লোড় শোনা যায়। যাঁদের ক্লাস নেই, তাঁদের দল বেঁধে আড্ডা চোখে পড়ে এখানে-সেখানে। আবার ক্লাস শুরু হলে দল বেঁধেই ছোটেন। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কারিগর হওয়ার স্বপ্ন তাঁদের চোখে-মুখে।
একাল-সেকাল
১৯৬৩ সালের ২৫ জুলাই রংপুর কলেজ নামে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। এখন কলেজটি যেখানে অবস্থান করছে, শুরুটা অবশ্য সেখানে হয়নি। তখন শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কৈলাশরঞ্জন উচ্চবিদ্যালয়ে রাতের বেলা ক্লাস হতো। আর দিনের বেলা কালিধাম এলাকায় রাম বাবুর জমিদারবাড়িতে চলত শিক্ষা কার্যক্রম। প্রথমে শুধু উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসের অনুমতি ছিল। পরে শিক্ষার মান বিবেচনা করে ১৯৬৫ সালে বিএ চালু করার অনুমতি মেলে। ১৯৬৭ সালে কলেজটি নিজস্ব ভবনে (বর্তমানের কলেজ) স্থানান্তর করা হয়। এরপর ১৯৭০ সালে বিএসসি চালু করার অনুমতি দেয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক এমাজ উদ্দিন, যিনি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রংপুর শহরের অফিসপাড়া হিসেবে পরিচিত কাচারিবাজার এলাকার উত্তরে স্টেডিয়ামের পাশে শহরের রাধাবল্লভ এলাকায় ৫ দশমিক ২৬ একর জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে রংপুর সরকারি কলেজ।
কলেজটি জাতীয়করণ করা হয় ১৯৮৪ সালের ১ নভেম্বর। তখন থেকে নাম হয় রংপুর সরকারি কলেজ। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে। ১৪টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর বিভাগ রয়েছে। শিক্ষার্থী আছেন প্রায় ১৫ হাজার। ওদিকে শিক্ষক মাত্র ৬২ জন। কলেজের তিনতলা ভবন আছে চারটি। রয়েছে বিশ্রামাগার। ক্যাম্পাসে মেয়েদের একটি ছাত্রীনিবাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে ছেলেদের একটি ছাত্রাবাস রয়েছে। শিক্ষার্থীদের চলাচলের জন্য একটি বাস ও শিক্ষকদের জন্য একটি মাইক্রোবাস রয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা জানালেন, তাঁদের প্রয়োজনীয় সংখ্যক ক্লাসরুম নেই। শিক্ষকের সংখ্যাও অপ্রতুল।
বর্তমান সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান এই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক সচিব আবদুস সাত্তার, রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র সরফুদ্দীন আহমেদও রংপুর সরকারি কলেজে পড়েছেন।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কলেজের ফলাফল বেশ ভালো। এইচএসবিসি-প্রথম আলো ভাষা প্রতিযোগে রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা ইতিপূর্বে পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন।

ঘুরে দেখা
কলেজটি চারদিক সীমানাপ্রাচীরে ঘেরা। গত সোমবার প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকেই প্রথমে চোখে পড়ল শহীদ মিনার। গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা পড়েছে কলেজের মূল ভবন। শহীদ মিনারের বেদি, খোলা মাঠ আর গাছের নিচে ছোট ছোট দল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন শিক্ষার্থীরা। ক্লাসের বাইরে বসে পড়ালেখাটা ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন কেউ কেউ। কবিতাপ্রেমী একটা দলকে দেখা গেল আবৃত্তিতে মশগুল। সবার চোখে-মুখেই ঘুরেফিরে খেলা করছে হাসির ঝলক।
কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী পার্থ প্রতিম রায় বললেন, ‘পড়াশোনা করতে এসে কলেজ ঘিরে অনেক স্মৃতি জমা হয়েছে। বহু বন্ধু পেয়েছি। কলেজজীবন শেষে যে যেখানেই যাই না কেন, একটাই চাওয়া, বন্ধুত্বটা যেন অটুট থাকে।’
উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী নাফসিয়া মাহবুব কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত ছাত্রীনিবাসে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমরা নিরাপদে আছি, ক্যাম্পাসেই আছি। শিক্ষক আর সহপাঠীদের সব সময় কাছেই পাই। তাই পড়ালেখাটা সহজ হয়।’
ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবদুল মাজেদ বলছিলেন, ‘কলেজের শিক্ষা নিয়ে ভালো মানুষ হতে চাই। দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি।’
পড়ালেখার বাইরে
কলেজের শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও পিছিয়ে নেই। ক্যাম্পাসে বিতর্কের ওপর নিয়মিত কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা এবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে একুশ আলেখ্য নামে একটি ছোটকাগজ প্রকাশ করেছেন। ছোটকাগজটির সম্পাদক বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সামিদুল ইসলাম বলেন, ‘জাতীয় দিবসগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে কবিতাপত্র বের করা হয়।’
রক্তের সেবা দিয়ে চলেছে ‘বাঁধন’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এই সংগঠনের সভাপতি ব্যবস্থাপনা বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আল মোমিন বলেন, ‘প্রাণের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে ঠিকই, কিন্তু আমি না থাকলেও এসব কাজ থেমে থাকবে না। তখন নিশ্চয়ই নতুন কেউ হাল ধরবে।’
‘প্রভাতি আসর’ নামে সাহিত্য সংগঠন তাদের সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রেখেছে। রয়েছে বিএনসিসি ও রোভার স্কাউট।

১০ তলা একাডেমিক ভবনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে
কানিজ উম্মে নাজমা নাসরীন
অধ্যক্ষ, রংপুর সরকারি কলেজ
আমাদের কলেজের সুনাম ছড়িয়ে আছে দেশ-বিদেশে। এখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে ভালো অবস্থানে আছে, এমন অনেক শিক্ষার্থীও আছে। আমরা সব সময় কলেজে ভালো পরিবেশ বজায় রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।
আমাদের শিক্ষার্থী অনেক। সে তুলনায় শ্রেণিকক্ষ কম, সেটা ঠিক। এই অপ্রতুলতা দূর করতে একটি ১০ তলা একাডেমিক ভবনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একটি ছাত্রীনিবাস করারও পরিকল্পনা আছে।