ছোটবেলার রোজা ও ঈদ
মনে পড়ে ছোটবেলার রমজান ও ঈদের কথা। প্রাইমারিতে পড়ছি। যত দুর মনে পড়ে তখন প্রচণ্ড গরম, ঝড় বৃষ্টি আর আমের দিন। বছরের এই সময়টা রোজা রাখা একটু কঠিন হয়। ছোট হলেও আমিও বেশ কয়েকটি রোজা রেখেছিলাম। রোজা রাখতে কষ্ট হলেও বড়দের উৎসাহের কারণে বেশ আনন্দই পেতাম।
এখনো মনে পড়ে ছোটবেলায় চৈত্র মাসে রোজা রেখে ছোট আম কুড়িয়ে পেলে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত হাতে নিয়ে ঘুরতাম কিন্তু খেতাম না। ভুলে একটু কামড় দিয়ে খেয়ে একটু পরে যখন মনে হতো আমি রোজা রেখেছি; তখন খুব ভয় লাগত আমার রোজা বুঝি ভেঙে গেল! তখন রোজা যাতে না ভাঙে সে জন্য কত দুশ্চিন্তাই না করতাম!
সেই দিনে গ্রামে সারা দিন খেতে খামারে বিভিন্ন কাজ করেও বেশির ভাগ মানুষই রোজা রাখত। তখনকার সময়ে মানুষ শেষ রাতে সাহরি খাওয়ার জন্য ঘুম ভেঙে যেত এলাকার কিছু লোকের দল বেঁধে ডাকাডাকিতে। আবার বৃষ্টি হলে হয়তো ডাকাডাকির লোক আসত না বা অন্য ঘরের লোক ডাকাডাকি করলেও হয়তো শুনতে পেত না। ফলে কেউ কেউ ধারণা করেই খেয়ে নিত। ডাকাডাকির কাজে আবদুল গনি ভাই নামে একজন লোক ছিলেন খুবই উজাড় করে দেওয়ার মতো। নিরক্ষর হলেও বিভিন্ন লোকের গজল গাওয়া থেকে শুনে শুনে যতটুকু মনে রাখতে পেরেছিলেন ততটুকুই গাইতেন এবং সঙ্গে কিছু কথা যোগ করে বিশেষ সুর দিয়ে ডাকতেন। সে কথা মনে পরলে তা আজও কানে বাজে।
তখনকার মানুষের মধ্যে রোজার সম্মান ও পবিত্রতার ব্যাপারে খুবই আন্তরিকতা ছিল। হোক সে হিন্দু কিংবা মুসলমান। তখন দেখতাম হিন্দু পুরুষ-নারীরাও প্রকাশ্যে কিছু খেতেন না। নারীরা নিজে থেকেই মাথায় কাপড় না দিয়ে কখনো বের হতেন না।
তখনকার ভাঙা বা কাঁচা ঘরে বসে সাধারণ চিড়া-গুড়ের শরবত, ছোলা বুটের সঙ্গে মুড়ি দু-একটা খেজুর বা ফল ইত্যাদির ইফতারে খুবই মজা পেতাম। কারও ঘরের ছাউনি ছিল খড়ের। দেখা যেত ইফতার করছে সেই মুহূর্তে বৃষ্টি নামল আর পানি পড়া শুরু করল, তখন তাড়াতাড়ি করে কোনো অংশে পানি পড়ে না সে দিক খোঁজাখুঁজি শুরু হতো। আবার কোনো কোনো সময়ে দেখা যেত ইফতার করতে গিয়ে দু একটা মুড়ি পড়ল, অমনি হাস মুরগি ভাঙা বেড়ার ফাঁকা দিয়ে ঢুকে তা খাওয়া শুরু করল। ইফতারের আগে সবাই যার যার কাজ শেষ করে ঘরে ফিরতে চেষ্টা করত। এভাবে প্রকৃতির পরশ মাখা ছিল সেদিনের রোজার মুহূর্তগুলো।
ঈদ এলে যে কি মজাই’ না পেতাম। নতুন টাকা, জামা-প্যান্ট, খেলনা-চশমা-ঘড়ি কত কিছুরই না আবদার করতাম! অবশ্য অনেকেরই তেমন কিছু কেনা সম্ভব হতো না। আজ মনে পড়লে ভালো লাগে যে আব্বা সব সময় অন্যদেরও কিছু কিনে দিতেন। কোনো লোক দেখানো বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে ছিল না। দেখা যেত, আমাদের উনি যা দিয়েছেন, অন্যকে তার চেয়ে ভালো কিছু দিয়েছেন। ব্যাপারটা তখন একটু ভালোও লাগত, আবার কিছুটা প্রতিহিংসাও লাগত। আজ আব্বা নেই, কিন্তু তার সে সব দিনের কথা মনে পড়লে অজান্তেই চোখে পানি এসে যায়।