জীবনে কিছু একটা করে দেখাতে হবে: সাবিরুল

সাবিরুল ইসলাম
সাবিরুল ইসলাম

সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। এখানে যাঁরা উপস্থিত আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ। আমাদের মধ্যে স্বপ্ন কাজ করে, জীবনে কিছু একটা করে দেখাতে হবে। তরুণদের সব সময়ই নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা উচিত। কারণ, আমাদের হাতে এখনো অনেক সময়। নিজেকে প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট সময় ও সুযোগ আছে। সব সময় মনে এই বিশ্বাসটা রাখতে হবে, আমরা অসাধারণ কিছু করতেই পারি। সময়ের স্বপ্নটি সময়ে বাস্তবায়ন করিনি, এই কথাটি মনে করে আজ থেকে ২০ অথবা ৩০ বছর পরে আমাদের ভেতরে কারোর যেন আজকের দিনটির জন্য আফসোস করতে না হয়। আমি অনেককে দেখেছি এমন আফসোস নিয়ে বাকি জীবনটুকু পার করে দিতে। তাঁদেরও সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কিছু করে দেখানোর, পৃথিবীর বুকে নিজের নাম লিখে যাওয়ার। এখানে উপস্থিত কাউকেই আমি সে অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে দেখতে চাই না। আমি এবার আমার গল্পটি বলি তোমাদের। আমি বড় হয়েছি পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট নামের জায়গাটিতে, পুরো লন্ডনের মধ্যে যেটি পরিচিত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরিদ্র এলাকা হিসেবে। আমি এমন একটা পরিবেশে বড় হয়েছি, যেখানে অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে না গিয়ে জড়িয়ে পড়েছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। আমি এমন একটা পরিবেশে এসব তরুণের সঙ্গেই বড় হয়েছি, তাদের নিয়েই আমার কাজের বিরাট একটা অংশ কেটেছে। ১১ বছর বয়সেই আরেকটি ঘটনা আমার জীবনের মোড় প্রায় ঘুরিয়ে দিচ্ছিল। অ্যাপিলেপ্সি নামক গুরুতর রোগটি যে আমার শরীরের একটি অংশ, তা আমি জানতে পারি ওই সময়ে। ওই কঠিন সময়ে আমিও ভেবেছিলাম, হয়তোবা জীবনে কিছুই করতে পারব না। পৃথিবীর বুকে ছাপ রেখে যাওয়ার যে অদম্য ইচ্ছা মনের ভেতর লালন করছিলাম, তার কিছুই হয়তো করা হবে না। কিন্তু আসলে তা শেষ ছিল না। জীবনে এমন অনেক মুহূর্ত আসবে, যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়ে মনে হবে এর থেকে হয়তো বা সামনে এগোনো সম্ভব নয়। কঠিন এই সময়ে সবারই উচিত একজন কাউকে নিজের অনুপ্রেরণার জায়গাটুকু দিয়ে দেওয়া, তার সাফল্য থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের ব্যর্থতার কারণগুলো খুঁজে বের করা। ১৩ বছর বয়সে আমার জন্য তেমনি এক অনুপ্রেরণার নাম হয়ে এসেছিল আমার এক বছরের বড় চাচাতো ভাই। মাত্র ১৪ বছর বয়স এবং স্কুলপড়ুয়া হওয়া সত্ত্বেও আমার এই ভাইটি নিজের ব্যবসা দাঁড় করাচ্ছিল ওইটুকুন বয়সেই! আমার জন্য এ আইডিয়াটি ছিল অসাধারণ একটি আইডিয়া। আমি এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম যে আমার ভাইকে অনুরোধ করেছিলাম তার কোম্পানিতে একটা চাকরি দিতে এবং আরও মজার অথচ দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, প্রোডাকশন ডিরেকটর হিসেবে সেই কোম্পানিতে কাজ করার মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় আমি ভাইয়ের কাছ থেকে বরখাস্ত হওয়ার চিঠিটি পাই। কিন্তু এখন বুঝতে পারি, এই ঘটনাটিই আমার জীবনের সব চিন্তাভাবনাকে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য একধরনের জেদ চেপে গিয়েছিল আমার। মনে হয়েছিল, কাজ দিয়েই দেখিয়ে দিতে হবে আমার ভাইটি কতটা ভুল ছিল। ওই জিদটাই ১৪ বছর বয়সে আমাকে বাধ্য করেছিল নিজের একটি ওয়েব ডিজাইন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে। শুরু করলাম পুরোদমে। এমনকি ওয়েব ডিজাইনিংয়ের ক্ষেত্রে আমি আমার ভাইয়ের চেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকলাম। স্কুল-কলেজে ওয়েব ডিজাইন না করে আমি লন্ডনের বড় বড় কোম্পানিতে ধরনা দিতে থাকলাম ওয়েব ডিজাইন করার জন্য। আমার এ আগ্রহই কোম্পানি তৈরির মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় দুই হাজার পাউন্ডের মুনাফা তৈরি করে দিল। দুই বছর ধরে কোম্পানিটি চালিয়েছি আমি। একটা অসাধারণ শিক্ষা পেয়েছি এসব থেকে তুমি নিজে যদি কোনো সুযোগ তৈরি করো, তাহলে সুযোগই আপনা থেকে তোমার কাছে ধরনা দেওয়া শুরু করবে। এভাবেই আমার পথচলা শুরু।

বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে করতে ১৬ বছর বয়সে আমার সুযোগ হলো নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শেখার। পৃথিবী কিন্তু আসলে তরুণদের সুযোগ দিতেই উদগ্রীব। কারণ, আমাদের বয়সটা নতুন, আমাদের চিন্তাভাবনা নতুন। আমাদের সামনে দীর্ঘ পথ রয়েছে। আমাদের তরুণদের শুধু দরকার একটু স্ফুলিঙ্গ, একজন উদাহরণ। কোথাও না কোথাও থেকে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হয়, আর কেউ না কেউ আমাদের অনুপ্রেরণাদানকারী হিসেবে দাঁড়িয়ে যান এবং এই অনুপ্রেরণাদানকারী কোনো সেলিব্রেটি নন, কোনো বড় ব্যক্তিত্বও হন না। তিনি হন আমাদের খুব কাছেরই একজন মানুষ। আমিও তরুণ প্রজন্মের জন্য তেমন একটা অনুপ্রেরণার জায়গা হিসেবে কাজ করতে চাই, কারণ হয়তো বা তরুণদের আমার সাহায্য প্রয়োজন। তাই ১৭ বছর বয়সে আমি আমার প্রথম বইটা লিখি। এই বইটি নিয়েও আমাকে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। আমার ওপরে প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করেনি। এমনও প্রশ্ন উঠেছে, ১৭ বছর বয়সে কেউ বই লিখতে পারে নাকি! আর লিখলেও সেই বইয়ের বাজার আছে নাকি! নিজের উদ্যোগে যখন সেই বইটি বের হলো, মাত্র নয় মাসের মাথায় প্রায় ৪৩ হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেল। আর মজাটা হলো তখন, যখন প্রথমে বইটির ওপর বিশ্বাস না করা চারজন প্রকাশক আমার কাছে এসে জানালেন, তাঁরা আমার বই প্রকাশ করতে চান। আসলে সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের সঙ্গে মিশতে পারাটাও কিন্তু সাফল্যের জন্য অবশ্যম্ভাবী। আমাদের নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে, যোগাযোগের নেটওয়ার্ক। আর আমাদের চৌকস হতে হবে, নতুন নতুন ব্যবসায়ী উদ্যোগ নেওয়ার ঝুঁকি নিতে হবে। নতুন প্রজন্মকে ব্যবসা সম্পর্কে আরও উদ্যোগী করার জন্য তাই আমি চালু করি ‘ইয়াং এন্ট্রাপ্রেনিউয়র বোর্ড গেম’, যা ইংল্যান্ডে অনেক বিদ্যালয়েই এখন পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। এ গেমটি সবাইকে এ বার্তাটিই দেয়, সীমিত মূলধনের মাধ্যমেও শুধু মেধা আর বুদ্ধি খাটিয়ে কোনো ব্যবসায় উদ্যোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।

তরুণ প্রজন্মকে আরও উদ্যোগী করতে গেলে তাদের একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাদের আরও শিক্ষিত করতে হবে, সঠিক পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে হবে। তোমরা যারা তরুণ, তাদের নিজেদেরই এখন এগিয়ে আসতে হবে সুযোগটা নিতে। নিজের জন্য রাস্তা তৈরি করতে হবে। দেখবে, এ একটি সুযোগ তৈরির জন্যই সামনে আরও ১০টি দরজা খুলে গেছে, সেটা কোথায়, কখন হবে কেউ বলতে পারে না। এ কথাগুলো আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। যখন আমার কাছে প্রথম নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্টের ফোন এল, তখন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তিন হাজার লোকের সামনে আমি এ কথাগুলোই বলেছি। আমি সেখানে দেখেছি মানুষের নতুন কিছু জানার সম্পর্কে আগ্রহ, আমাকে নিয়ে তাদের মাতামাতি। আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছি, সেখানে অনেক অনুষ্ঠানে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছে, কেমন করে তারা আরও চমকপ্রদ চিন্তা দিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ সাজাতে পারে।

তরুণ প্রজন্মকে এটাই জানাতে চাই, সব সময় ইতিবাচক চিন্তা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। বাধা আসবেই, কিন্তু পিছপা হলে চলবে না। নিজের ওপর বিশ্বাস হারানো যাবে না। কিছু একটা অর্জন করতে গেলে নিজের চিন্তাগুলোর ওপর আস্থা রাখা, মনোবল দৃঢ় রাখার কোনো বিকল্প নেই। বুদ্ধি আর সঠিক চিন্তাশক্তির গুরুত্ব তো সব জায়গায়ই আছে। এসবের সঙ্গেই যদি কঠোর পরিশ্রম আর কাজের প্রতি একাগ্রতা নিয়ে আসা যায়, তোমাদের কেউ রুখতে পারবে না। পৃথিবীটা হবে তোমাদের।

সূত্র: ওয়েবসাইট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আফরিনা হোসেন

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তরুণ সাবিরুল ইসলাম ২০১০ সালে আমস্টারডাম টেডেক্স ইয়ুথ সম্মেলনে তরুণদের সামনে এই বক্তব্যটি দেন। বিশ্বব্যাপী ১০ লাখ তরুণকে ব্যবসাক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

l আজ প্রথম আলোয় আসছেন সাবিরুল। নির্বাচিত ৫০০ শিক্ষার্থী ও তরুণ উদ্যোক্তা অংশ নিচ্ছেন আজকের অনুষ্ঠানে।