জীবনে নেমে এল আঁধার...
কার্তিকের এক মেঘলা দুপুরে ঘর আলো করে এল ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান সভ্য। সব ঠিকঠাক । তবে মাসখানেক পর হঠাৎ সভ্যর মা সুমাইয়া শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করলেন।
গত ডিসেম্বরে সুমাইয়ার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে বাসার কাছে একটি হাসপাতালে ভর্তির পর প্রাথমিক চিকিৎসায় উন্নতি হলেও কিছুতেই কমছিল না শ্বাসকষ্ট। গত ১৫ ডিসেম্বর শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি। মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের চিকিৎসকেরা সুমাইয়াকে দেখে ভীষণ চমকে উঠলেন। বললেন, রোগীকে আইসিইউ/সিসিইউতে নিতে হবে। আত্মীয়স্বজনকে খবর দেন, অবস্থা খুবই খারাপ!’
সন্তানের বাবা হিসেবে আমার জন্য ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। চোখের সামনে মেয়ের মা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে! মাত্র দুই মাস আগে মা হয়েছে সে। হঠাৎ জীবনে নেমে আসে আঁধার, পুরো পরিবার কী ঘোরতর বিপর্যয়ে। একদিকে মুমূর্ষু রোগী, অন্যদিকে তাঁর দুই মাসের সন্তান।
চিকিৎসকেরা জানান, সুমাইয়া আক্রান্ত পেরিপার্টাম কার্ডিওমায়োপ্যাথিতে। রোগটা এমনই ভয়ংকর, সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা গেলে হার্ট কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন মৃত্যুই এ রোগের একমাত্র পরিণতি।
১০ দিন হাসপাতালবাসের পর শেষ পর্যন্ত সুমাইয়া তাঁর সন্তান ও পরিবারের কাছে ফিরেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
পোস্টপার্টাম বা পেরিপার্টাম কার্ডিওমায়োপ্যাথি হচ্ছে হার্টের অস্বাভাবিক একটি রোগ, যা মায়েদের গর্ভধারণের সময়, নির্দিষ্ট করে বললে বাচ্চা প্রসবের এক মাস আগে থেকে বাচ্চা প্রসবের পাঁচ থেকে ছয় মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে।
এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের হৃৎপেশি ভীষণ দুর্বল হয়ে পাম্পিং ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। হার্ট অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যায়। মাংসপেশির ক্ষমতা হ্রাস পায়। হার্টের দেয়াল পাতলা হয়ে যায়। রক্তচাপ আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। রোগীর ভীষণ শ্বাসকষ্ট হয়, স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসা না হলে রোগীর জীবনহানির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বংশগত কারণ, উচ্চ রক্তচাপ, ভাইরাস ও অপুষ্টির কারণে এটি হতে পারে। ৩০ বছরের বেশি বয়সী নারী, একাধিক সন্তানের মা, প্রি–একলাম্পশিয়া (উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগ), একলাম্পশিয়া (উচ্চ রক্তচাপ ও খিঁচুনিজনিত রোগ), বাচ্চা প্রসবের পর উচ্চ রক্তচাপে থাকা মায়েরা ঝুঁকিতে থাকেন।
পরিশ্রম বা ওঠাবসা করার সময় মায়েদের শ্বাসকষ্ট হওয়া, শরীর অস্বাভাবিক দুর্বল লাগা, বুকে অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভব হবে। পায়ে পানি আসা, পেটে অস্বস্তি লাগা, পেট ফুলে যাওয়া, সর্বোপরি হৃদ্যন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যায়।
এ রোগে আক্রান্ত ৭০ ভাগ রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে। সাধারণত ছয় মাসের মধ্যে হার্টের কার্যক্ষমতা ও আকার আগের জায়গায় ফিরে আসে। কারও কারও হার্টের সমস্যাটা স্থায়ী হয়ে যায়। এ রোগ নিয়ে মায়েদের ভীষণ সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের এই দেশে এ রোগ নির্ণয় হয় কম। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও ভালো চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব।
অধ্যাপক ডা. নাজির আহমেদ ও ডা. আসিফুদ্দোজা
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট