জুনিয়র সিনিয়র
বেশ কয়েক বছর ধরে আমি লস অ্যাঞ্জেলেসে আছি। এখানে আসার পর যে কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তাঁদের মধ্যে সাচ্চু ভাই একজন। প্রথম পরিচয়ের দিনই তিনি জানতে চাইলেন, আমি কবে এসেছি। তাঁকে আমি আসার তারিখ বললাম। সাচ্চু ভাই কী যেন একটু চিন্তা করে বললেন, আপনি এসেছেন আমার স্ত্রী আসার এক বছর পর। আপনি এক বছরের জুনিয়র।
সাচ্চু ভাইয়ের কথায় বুঝলাম, আমি তাঁর স্ত্রী আসার এক বছর পর এসেছি। কিন্তু জুনিয়র কথাটার মানে বুঝলাম না।
কিছুদিন পর আবার সাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। আমাকে সঙ্গে করে বাংলাদেশি এক গ্রোসারি দোকানে ঢুকেই সাচ্চু ভাই তাঁর স্ত্রীকে ফোন করলেন। দোকানে পায়চারি করছেন আর ফোনে বেশ উচ্চকণ্ঠে কথা বলছেন। একসময় তিনি বললেন, মসুর ডালের দুই পাউন্ডের প্যাকেট আনব নাকি পাঁচ পাউন্ডের প্যাকেট আনব?
অপর প্রান্ত থেকে তাঁর স্ত্রী কী বলছেন সেটা আমার শোনার কথা নয়। সাচ্চু ভাই যে ফোনে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন সেটা আমি ছাড়া আরও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি আসলে ডাল কিনতে এসেছেন নাকি স্ত্রীকে ফোন করে অন্যদের দেখাতে এসেছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
স্ত্রী-রোগ ব্যাপারটি আমার কাছে কেমন যেন বেখাপ্পা লাগে। অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হলেও সাচ্চু ভাইয়ের বিষয়টা একেবারে পরিষ্কার। একদম জন্ডিস রোগীর মতো।
এ ঘটনার কিছুদিন পর সাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আবার একই দোকানে দেখা। তিনি বলতে গেলে আমাকে জোর করে চেপে ধরে একটা চেয়ারে বসালেন। চোখ বড় করে আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনার ভাবি যে গত মাসে দেশে গিয়েছে আপনি কি জানেন?
আমি থতমত খেয়ে জবাব দিলাম, না সাচ্চু ভাই, আমি জানি না। আমাকে তো বলে যাননি। আর আপনিও তো আমাকে কিছু বলেননি।
আপনাকে বলে যেতে হবে কেন? মুরব্বিদের খোঁজখবর রাখা কি আপনার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না? আমি মাথা নত করে বললাম, ভুল হয়ে গেছে সাচ্চু ভাই। তিনি একটু রাগত গলায় বললেন, আপনি যেন কবে এসেছেন?
আমি কবে এসেছি সে তারিখ আমার মনে আছে। কিন্তু কী বললে তিনি খুশি হবেন, আমি সে রকম জুতসই বাক্য খুঁজছিলাম। কারণ, এর আগে যতবারই সাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে ততবারই তিনি তাঁর স্ত্রীর প্রসঙ্গ তুলেছেন। আমি যদি বলেছি, সাচ্চু ভাই কেমন আছেন? তিনি জবাব দিয়েছেন, ভালো আছি, আপনার ভাবিও ভালো আছে। এ অবস্থায় আমি ধরেই নিয়েছি সাচ্চু ভাই স্ত্রী-রোগে আক্রান্ত। কোনো না-কোনোভাবে তিনি স্ত্রীর প্রসঙ্গ তুলবেনই এবং তাঁকে বিখ্যাত করে ছাড়বেনই।
যা হোক, আমি জবাব দিলাম, ভাবি আসার এক বছর পর। আমি ভাবির এক বছরের জুনিয়র। আমার কথায় সাচ্চু ভাই বেজায় খুশি হলেন। আর আমিও নিজের ওপর বেশ সন্তুষ্ট হলাম। সময় মতো জুতসই জবাব দিতে না পারায় এর আগে আমি বহু জায়গায় হেনস্তা হয়েছি।
এরপর অনেক দিন সাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা নেই। কারও কাছে তাঁর খবরও নেওয়া হয়নি। হঠাৎ কয়েক দিন আগে সাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। ভাবির কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, আপনার ভাবি দেশে গেছে দুই বছরের বেশি হলো। আমিও দেশে ছিলাম। গত পরশু এলাম।
তাঁর কথা শুনে আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। জুতসই উত্তর খুঁজছিলাম। আমার মুখ কাঁচুমাচু অবস্থায়। সাচ্চু ভাই এটা বুঝতে পেরে বললেন, কিছু বলবেন?
আমি বললাম, না সাচ্চু ভাই, তেমন কিছু না। ভাবি যে একটানা দুই বছর দেশে রয়েছেন। তিনি তো আমার জুনিয়র হয়ে যাচ্ছেন।
আমার কথা শুনে সাচ্চু ভাই মুখ কালো করে ফেললেন।
আমি আগেও লক্ষ্য করেছি সাচ্চু ভাই আমাকে তাঁর স্ত্রীর জুনিয়র বানাতে যারপরনাই চেষ্টা করেছেন। আমি তাঁর সেই চেষ্টায় কখনো বাধা দিইনি। প্রথম বুঝতে পারিনি বলে খটকা লেগেছিল। কিন্তু তাঁর স্ত্রী-রোগটা আমার কাছে পরিষ্কার হওয়ার পর তাঁকে হ্যান্ডেল করা তেমন কষ্ট হয়নি। তাই সাচ্চু ভাইকে খুশি করার জন্য বললাম, সিনিয়ররা কখনো জুনিয়র হয় না সাচ্চু ভাই। সিনিয়র ইজ অলওয়েজ সিনিয়র। ভাবি দেশে দুই বছর ধরে অবস্থান করছেন। এ হিসাব আমি কষলেই কী, না কষলেই কী? এটা জাস্ট একটা কথার কথা।
পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে চোখ বড় করে সাচ্চু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, চলুন চা খাই।
তপন দেবনাথ
লস অ্যাঞ্জেলেস, যুক্তরাষ্ট্র।