
বড় সিন্দুকের একটি বাক্সে আজ ডায়েরিটা পেলাম। অনেক ধুলা জমেছে মলাটে। লেখাগুলো ধূসর হয়ে যাচ্ছে। কত কত কথা, আর কত কত ব্যথা যে জমা হয়ে আছে পাতায় পাতায়! অনেক দিন পর স্মৃতিগুলো নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। বয়সের হয়তোবা রেখা পড়েছে গালে, কিন্তু মস্তিষ্ক এখনো ধোঁকা দেয় না।
আজ সেই উজানের হাওয়া দেওয়া জানালাটার পাশে বসে তোমাকে খুব মনে পড়ছে। দক্ষিণের সেই ‘হাওয়া’ ঘরটা, তোমার আর আমার সব সময়ের প্রিয় সেই ঘর...
নীল আকাশে তারাদের মাঝে তোমাকে খুঁজে ফিরছি, জানো। কোথায় আছ তুমি বলো তো?
বিশাল বড় এই বাড়িটা। আজকের এই মফস্বল শহর তখন এমন ছিল না। ছোটখাটো একটা গ্রাম, আর ছিল তার ঐশ্বর্য। সহজ–সরল গ্রামের মানুষগুলোর মনে আনন্দের কমতি ছিল না, ভালোবাসার কমতি ছিল না।
গ্রামের মেঠোপথগুলো সব এসে এখানেই শেষ হয়ে যেত। আর কিচ্ছু ছিল না চারপাশে। কেবল গাছপালার সারি, বনজঙ্গল। আর তার মাঝে মাঝে দু–একটা বাড়িঘরের মাথাগুলো উঁকি দিতে দেখা যেত। রাতের বেলায় জায়গাটাকে ভূতের আড্ডাখানা মনে হতো। নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝে টিমটিমে জ্বলতে থাকা ওই কুঁড়েঘরগুলোর অস্তিত্ব অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে তুলত। ভয়ার্ত সেই অন্ধকারের বুক চিরে মাথা উঁচিয়ে তখন দাঁড়িয়ে থাকত এই ‘বড়বাড়ি’।
এখন আর কিছুই নেই সেসব। সাদা ফ্লুরোসেন্টের আলোয় এখন সব পরিষ্কার দেখা যায়। কেউ আর এখন অন্ধকারকে ভয় করে না। রাতের বেলায় আকাশের বুকে সগর্বে জ্বলতে থাকা চাঁদটাকেও আর আগের মতো দেখা যায় না। কৃত্রিম আলোর বন্যা চাঁদকেও আজ ছাপিয়ে যায়, বহুগুণে।
১৪ বছরের আমি যখন এই বাড়িটায় পা দেই, আমার তখন পুতুল খেলার বয়স। কিছুই বুঝি না, সংসার কাকে বলে, দায়িত্ব কাকে বলে। লাল টুকটুকে শাড়ি পরে এতগুলো গয়না গায়ে–মাথায় জড়িয়ে সেদিন তোমার কাছে একেবারে চলে আসি। কী ভয়, কী নিদারুণ সংকোচ ছিল আমার ভেতর!
তুমি, এই এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া প্রথম ছেলে, জমিদার বংশ। কত কিছু বলা হয়েছিল আমাকে—তোমার সঙ্গে সমঝে চলতে, সব সময় আদবকায়দা বজায় রেখে চলতে, আর কখনোই তোমার কথার ওপর কথা না বলতে।
তখনকার ওই অস্থির সময়টাতে, যখন দেশ বদলাচ্ছে, সমাজ বদলাচ্ছে, মানুষের চিন্তাগুলোও বদলে যাচ্ছে, কারও কপালে তখন এমন বর জুটেছিল কি না জানি না।
আমার ওই খেলার বয়সটায়, আমি তোমাকেই আমার খেলার সাথি বানিয়ে নিলাম। বেশ অনেকগুলো বছর আমি তোমাকে পাইনি। তুমি পড়াশোনা করার জন্য বাইরে চলে যেতে। কিন্তু যখন ফিরে আসতে, আমার ঈদ হয়ে যেত। ওই কয়টা দিনের জন্য আমি সারাটা সময় অপেক্ষা করতাম।
একে একে সংসার বড় হয়, দিনগুলো কেটে যেতে থাকে। কোন ফাঁকে সময়গুলো পথ পাড়ি দিয়ে চলে গেছে, বুঝতে পারি না। আমাদের ভালোবাসার সম্পদগুলো বড় হয়, যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমনটাই হওয়ার কথা। তোমার বিশাল সংসার, একসময় শূন্য হয়ে পড়ে। প্রাণচঞ্চল বাড়িটায় একসময় মানুষের জায়গা দেওয়া যেত না। অথচ, আস্তে আস্তে সব স্তিমিত হয়ে পড়ে। শূন্য উঠানে আর কেউ খেলা করে না, গাছপালাগুলো মনমরা হয়ে পড়ে থাকে, কার প্রতীক্ষায়, কে জানে।
সবই একসময় বদলে যায়। ভালোবাসা বদলায় না। যেমনটা তোমার ভালোবাসা বদলে যায়নি, যেমন আমার ভালোবাসা তোমার জন্য, বদলায়নি।
আর বদলায়নি নদীটার একটানা করুণ সুরে বয়ে চলার গান। শান্ত–সুনিবিড় এই স্রোতোধারা এখনো জানান দিয়ে যাচ্ছে, সে বেঁচে আছে, থাকবে।
নদীর তীরে দাঁড়িয়ে, বাড়ির দিকে মুখ করে চেয়ে থেকে, তোমার গলা ফাটানো, ‘ওগো বউ, শুনতে কি পাও?’ চিৎকার...আমি যেন এখনো শুনতে পাই। মাঝে মাঝেই...
একটাবার বলে যাও তো, তুমি কি শুনতে পাও?
ডিওএইচএস, মহাখালী, ঢাকা