ট্রেকিং, অ্যাডভেঞ্চার, ভেলায় চড়ার আনন্দ—সব এক জায়গায়

বাঁশের ভেলায় পথচলা
ছবি: জুয়েল শীল

চারপাশে সুনসান নীরবতা। একটু পরপর সেই নীরবতা ভাঙছে টুপটাপ পানি পড়ার শব্দ আর জলপথ ধরে চলা ভেলার আওয়াজে। বান্দরবানের দেবতাখুমের এই ভুতুড়ে পথ ধরে এগোতে এগোতে যে কারও মনে হতে পারে—সত্যিই বুঝি এখানে একদিন দেবতাদের আনাগোনা ছিল!

শান্ত প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া যায় এখানে
ছবি: জুয়েল শীল

বড় বড় দুই পাহাড়ের মাঝখানে এই খুম (যেখানে পানি জমে)। খুমের ভেতরের দিকটা এতটাই অন্ধকার—সূর্যের আলোর দেখা মেলা বড় কঠিন। প্রকৃতিকে খুব কাছে থেকে উপভোগ করতে চাইলে এর চেয়ে ভালো কিছু হয় না। যেন মিশে যাবেন প্রকৃতির সঙ্গেই।

দেবতাখুম বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলায় অবস্থিত। স্থানীয় গাইড শন্তু মারমা বলেন, এই খুমের গভীরতা জায়গাভেদে ৫০ থেকে ৮০ ফুট এবং দৈর্ঘ্যে এটি প্রায় ৬০০ ফুট। বান্দরবানে যতগুলো খুম আছে, সেসবের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বন্য। তাই ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে জায়গাটা বড় প্রিয়।

একটু ঘুম!
ছবি: জুয়েল শীল

এই দেবতাখুম নিয়ে নানা রূপকথা প্রচলিত আছে। তারই একটি হলো: ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ তারাছা খালের ঝিরিপথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আশা একটাই, যদি গভীর আর বুনো অরণ্যে ঘেরা এই খুম থেকে বেশি মাছ পাওয়া যায়। ঘুরতে ঘুরতে বৃদ্ধ কখন যে খুমের একদম গভীরে বিশাল এক পাথরের কাছে চলে এসেছেন, বলতেই পারেন না। মাছ ধরার ফাঁকে হঠাৎ করেই দৈত্যাকৃতির এক কচ্ছপ দেখে ভয়ে নিজের প্রাণ নিয়ে দৌড়ে পালান তিনি। শীলবাঁধা পাড়ায় ফিরে এসে বৃদ্ধের প্রচণ্ড জ্বর আসে রাতে। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখেন সেই কচ্ছপ তাকে বলছে, ‘আমাকে ভয় পাসনে। বরং আমার কথা সবাইকে বলবি। আমি তোদের দেবতা। তোরা যখন মাছ ধরতে যাবি, তখন ওই রাজ পাথরের ওপর পুজোর থালি সাজিয়ে প্রার্থনা করে অনুমতি নিয়ে নিবি। আর খবরদার, আমার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করবি না। এর পরিণতি ভালো হবে না।’

এভাবেই বেলা সাড়ে ১১টার ঝকঝকে আকাশের নিচে পুরু গাছের বন, এলোমেলো আর উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেবতাখুমের নামকরণের ইতিহাস শোনাচ্ছিলেন আমাদের গাইড রতন মারমা। যদিও এই গল্প নিয়ে ভিন্নমতও আছে।

স্থানীয় এই নৌকাও ভ্রমণের জন্য জনপ্রিয়
ছবি: জুয়েল শীল

চট্টগ্রাম জিইসি মোড় থেকে ‘চলো দেশটা ঘুরি শেয়ারে’ ফেসবুক পেজের মাধ্যমে আমরা ৪০ জন বাসে করে বান্দরবান শহরে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে জিপে করে রোয়াংছড়ি উপজেলার কচ্ছপতলী বাজারে। তারপর লিরাগাঁও সেনানিবাসে অনুমতি নিয়ে দেবতাখুমের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করি।

আমাদের ৪০ জনের জন্য চারজন গাইড নিয়েছেন ‘চলো দেশটা ঘুরি শেয়ারে’ পেজের অ্যাডমিন আবদুল বাসাত। দেবতাখুম টেইলরে ৪০ জনের মধ্যে ১৬ জন ছিলেন নারী। পাহাড়, বন, নদী ও ঝিরির পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করেন সবাই। চারপাশে পাখির ডাক, সবুজ বন, ছড়ানো ছিটানো ছোট–বড় পাথর আর কলকল শব্দে অবিরাম বয়ে যাওয়া ঝিরির পাশ দিয়ে হেঁটে চলা। এসবের মধ্য দিয়ে হেঁটে প্রায় ৩০ মিনিট পর আমরা পৌঁছাই শীলবাঁধা পাড়ায়। সেখানে পানি ও কিছু ফল খেয়ে ৫ মিনিট হেঁটে পৌঁছাই দেবতাখুমে।

দেবতাখুমে লাইফ জ্যাকেট পরে সবাই ভেলাতে ওঠেন
ছবি: জুয়েল শীল

দেবতাখুমে লাইফ জ্যাকেট পরে সবাই ভেলায় ওঠেন। কেউ ছবি তোলেন, কেউ পাহাড়টাকে ধরে দেখেন, কেউ আবার ভেলা থেকে লাফ দিয়ে স্বচ্ছ শীতল পানিতে গোসল করেন। ভেলায় ভেসেই ঘোরেন বেশির ভাগ পর্যটক। নৌকা নিয়ে দেবতাখুমে যাঁরা প্রবেশ করেন, মন খুলে গান ধরেন অনেকে।

চারপাশে পাখির ডাক, সবুজ বন, ছড়ানো ছিটানো ছোট বড় পাথর, আর কলকল শব্দে অবিরাম বয়ে যাওয়া ঝিরির পাশ দিয়ে হেঁটে চলা...
ছবি: জুয়েল শীল

ট্রেকিং, অ্যাডভেঞ্চার, ভেলায় চড়ার আনন্দ—যাঁরা এক ভ্রমণেই এমন ‘কম্বো প্যাকেজ’–এর স্বাদ চান, তাঁদের মনের বন্ধ জানালা খুলে দিতে পারে এই দেবতাখুমই!