তাঁর গল্পে নেই পরাজয়

বিনোদনজগতে যত কুসংস্কার প্রচলিত, সেগুলোর অন্যতম—বিয়ের পর নারীদের ক্যারিয়ার থাকে না। আর যদি বাচ্চা হয়েছে, তো ক্যারিয়ারের কফিনে শেষ পেরেকটিও পোঁতা হয়ে গেল। কিন্তু যাঁকে নিয়ে এই লেখা, তাঁর পেশা যেন শুরুই হলো সন্তানের হাত ধরে। নামের আগে ডিভোর্সি ও সিঙ্গেল মাদারের ট্যাগ লাগিয়েই। পেশাজীবনের সেই কঠিন পিচে একটা–দুটো ভালো বল পেয়েছেন কী, পিটিয়ে বাউন্ডারি! রেহানা মরিয়ম নূর–খ্যাত অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনের কথা

একের পর এক সাফল্যের খবর দিচ্ছেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনছবি: প্রথম আলো

ধ্বংসস্তূপ ফুঁড়ে আলোর ঝলকানি

আজমেরী হক বাঁধনের একটা সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম। সেখানে তিনি বলেছেন, ২০০৫ সালে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। সেই সময় যদি সত্যিই তিনি সে রকম কিছু করে ফেলতেন, তবে এ বছর ৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘আঁ সার্তে রিগা’য় নির্বাচিত হয়ে লালগালিচায় জামদানি শাড়িতে কে বাংলাদেশকে তুলে ধরতেন? এ কথা বলতেই ফোনের ওপাশে হাসি। বাঁধন বললেন, ‘আমি আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংসস্তূপ থেকে ভাঙাচোরা অবস্থায় উঠে আসা এক মানুষ। যে জায়গা থেকে আমি এসেছি, আমার আশেপাশে কাউকে সে রকম জায়গা থেকে ফিরে উঠে দাঁড়িয়ে লড়ে বিজয়ী হতে দেখিনি। আমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে, এরপর আমার আর হারানোর কিছু নেই। এ জন্যই হয়তো আমার ভেতর একটা ভীষণ মনোবল কাজ করে। আমি যা করি, মরিয়া হয়ে করি।’

সম্প্রতি বাঁধন ভারতের মুম্বাইয়ে বিশাল ভারদ্বাজেরখুফিয়া ছবির শুটিং করে ফিরলেন। সে ছবিতে আছেন বলিউডের অন্যতম গুণী অভিনেত্রী টাবুও। টাবুর জন্মদিনে সচরাচর ‘গোমড়ামুখো’ টাবুকে দেখা গেল হাসিমুখের বাঁধনের সঙ্গে, বাঁধনের শেয়ার করা ছবিতে। টাবুর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বাঁধন বললেন, ‘তিনি আমাকে একমুহূর্তে আপন করে নিয়েছেন। আসলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে নারীদের সংগ্রামের গল্পগুলো প্রায় একই রকম। যাঁরা উঠে আসেন, তাঁরা কাঁটা বিছানো পথ মাড়িয়েই আসেন। তাই খুব সহজে তাঁরা বন্ধু হয়ে যেতে পারেন। আমার আর টাবুর বেলাতেও সেটা ঘটেছে। টাবু তো আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বললেন। জানালেন, বাংলাদেশে তাঁর এক বন্ধু আছে—চম্পা। আমাদের চম্পা আপু।’

হঠাৎ বদলে গেছে বাঁধনের জীবন, এখন তিনি ব্যস্ত তারকা
ছবি: কবির হোসেন

বাংলাদেশ থেকে বাঁধন টাবুর জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন জামদানি শাড়ি। আর বেশ কয়েকটি জামদানির ওড়না নিয়ে গিয়ে দেখেন, ছবির সেটে নারীর সংখ্যা তাঁর নিয়ে যাওয়া ওড়না থেকে ঢের বেশি। বললেন, ‘কী যে ভালো লাগল দেখে। একটা সেটে এত নারী টেকনিশিয়ান, সহকারী, মেকআপ আর্টিস্ট আমি আগে দেখিনি। ওখানে কাজের ধারাটাই অন্য রকম। ঢাকা বা কলকাতা থেকে অনেক বেশি পেশাদার।’

মাদার তেরেসা যে বছর (১৯৯৭) মারা গেলেন, বাঁধন তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। সেই সময় বাঁধন কী মনে করে ডায়েরিতে লিখেছিলেন, তিনিও জীবনে ভালো কিছু করতে চান, যাতে সবাই তাঁকে চেনে। এরপর ২০০৬ সালে লাক্স–চ্যানেল আই সুপারস্টারের মঞ্চে দ্বিতীয় রানারআপ হলেন। খানিক জ্বলে উঠেই আবার চলে গিয়েছিলেন পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে। তারপর বিয়ে, অসুখী জীবন, বিচ্ছেদ, লুকিয়ে থাকা, সন্তানের অভিভাবকত্বের জন্য লড়াই—সব পেরিয়ে পাওয়া নতুন জীবন একেবারে নতুন করেই গড়েছেন তিনি।

আইনি লড়াই শেষে মেয়েকে পেয়েছেন বাঁধন

বাঁধনের ভাষায় এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় জন্ম। আর দ্বিতীয়বার জন্মানোর সুযোগ পেয়ে সেটি দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। বললেন, ‘আমাকে লোকে বলে ডাইনি। বিশেষ করে মুসকান (রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি ওয়েব সিরিজের প্রধান চরিত্র) করার পর থেকে। আগে বলত, বিচ্ছেদের পর আমার গলা বড় হয়েছে, আমি বেয়াদব হয়েছি। খারাপ মেয়ে আমি। আমার এগুলো কিন্তু ভালো লাগে। এসব আমাকে আরও সাহসী আর আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। কারণ আমি জানি, যখনই আমি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ছকে পড়ব না, তখনই আমাকে এগুলো শুনতে হবে। আমাকে এসব নামে ডাকা হচ্ছে, এর মানে আমি ঠিক পথেই আছি।’

কথায় কথায় বাঁধন জানালেন, আজ তাঁকে সবাই যেমন দেখছে, তিনি এমন ছিলেন না। ছিলেন ভীষণ ভিতু। সমাজের ভয়ে নিজেকে আর নিজের বিচ্ছেদের কথা লুকিয়ে রেখেছিলেন দুবছর। ভেবেছিলেন, লোকে জানলে কী হবে!

এখন বাঁধন আর কোনো কিছুতেই ভয় পান না। ‘আমি চাই, আমার সায়রা (একমাত্র মেয়ে) যেন নির্ভয়ে বড় হয়। সে যেন তার অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে। বিনোদনজগৎকে লোকে খারাপ বলে। আমার সন্তানের রক্ত–মাংস হয়েছে বিনোদনে কাজ করা টাকায়। আমাকে তো উঠে দাঁড়াতেই হতো। আমার সন্তানের জন্য হলেও আমাকে ফিরে আসতেই হতো।’