তাদের জন্য ভালোবাসা

ফেসবুকে শুরু। তারপর কেয়ার ফর পজ নামের তরুণদের সংগঠন কীভাবে এক করল রাজধানীর বহু প্রাণীপ্রেমীকে? মানুষের নির্মমতার শিকার প্রাণীরা কীভাবে পেল নিরাপদ ঠিকানা?

‘আমি তিন তলার বারান্দায় বসে আছি। সেখান থেকে চোখ যায় পাশের বিল্ডিংয়ে, দেখি যে একটা মেয়ে ছোট্ট এক বিড়ালছানার ওপর অনবরত লাফাচ্ছে। নির্মম দৃশ্য! আমি অতি দ্রুত নেমে যাই বিড়ালটিকে বাঁচাব বলে। কিন্তু আমি গিয়ে পৌঁছার আগেই বিড়ালটি মারা যায়। আমার আফসোসের সীমা রইল না। কয়েক দিন পর আবারও একই ঘটনা—সেই একই মেয়ে একটি বিড়ালের গলা দড়িতে ঝুলিয়ে চরকির মতো মাথার ওপর ঘোরাচ্ছে। ভাইয়া আর আমি গিয়ে সে যাত্রায় ওকে উদ্ধার করি। সেই থেকে ও আমাদের ঘরের বাসিন্দা। ওর নাম নাডু—খুব দুষ্টু ছিল তো তাই! এই পর্যন্ত আমাদের ঘরে তিনবার বাচ্চা দিয়েছে সে।’
জাহিদ হোসেন বলছিলেন, ২০১১ সালের কথা। ধীরে ধীরে বিড়ালের প্রতি মায়া বেড়ে যায় এই নৌ প্রকৌশলীর। পথের পাশের অসহায় কুকুর, বিড়ালও তাঁদের ঘরে উঠে যত্নের ভাগ বসাতে শুরু করে। বর্তমানে তাঁদের আশ্রয়ে আছে সর্বমোট ২৯টি বিড়াল ও ৭টি কুকুর। এদের নামগুলোও চমৎকার—সিজার, হোয়াইটি, মনি, ডেনবার, ডবি, বার্ডলি ও রোমিও। শুধু জাহিদই নন, তাঁর মা ফেরদৌস আক্তার, বোন মাহিনুর আক্তার ও কোহিনূর আক্তারও ওদের যত্নে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেঙ্গ আছেন, ফুফাতো ভাই সৌরভ শামীমও।
এরই মাঝে কেয়ার ফর পজের প্রতিষ্ঠাতা ফারহানা হক চৌধুরীর সঙ্গে তাঁদের পরিচয়। জাহিদ হোসেন বলছিলেন, ‘ ফারহানা আমাদের মতো এমন প্রাণীপ্রেমিক আরও অনেককে খুঁজে বের করে একত্র করে প্রতিষ্ঠা করলেন কেয়ার ফর পজ।’

থাবার জন্য ভালোবাসা
‘কেয়ার ফর পজ’ একটি প্রাণিকল্যাণ সংগঠন। রাস্তায় আহত অবস্থায় পড়ে থাকা মালিকানাহীন বেওয়ারিশ কুকুর, বিড়াল তুলে আনে কেয়ার ফর পজের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক দল। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা আর যত্ন-আত্তিতে বেড়ে ওঠে ওরা। সংখ্যায় বেশি হলে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে আপলোড করা হয় সুস্থ হয়ে ওঠা প্রাণীটির ছবি। ফেসবুকের সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে এদের দত্তক নিয়ে যান পোষা প্রাণীপ্রিয় লোকজন। এরই মধ্যে সদস্যসংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়া এই সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে গত বছরের ৫ ডিসেম্বর। এই উপলক্ষে সংগঠনটির সহযোগিতায় রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগ ওই দিন স্বল্পমূল্যে পোষা প্রাণীর টিকাদান কর্মসূচি পালন করে। শেকৃবির মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের চেয়ারম্যান কে বি এম সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে টিকাদান কর্মসূচিতে অংশ নেন ‘এনিম্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন’ অনুষদের লেভেল-৪ সেমিস্টার-২-এর শিক্ষার্থীরা।
কেয়ার ফর পজের প্রতিষ্ঠাতা ফারহানা হক চৌধুরী (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন) ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাইমা ফেইরুজ। ই-মেইল বার্তায় প্রতিষ্ঠাতা ফারহানা হক চৌধুরী জানালেন সংগঠনটির কার্যক্রমের কথা, ‘প্রায়ই অনেককে বলতে শুনি—মানুষ রাস্তায় না খেয়ে মরে, আর এরা আছে রাস্তার কুকুর-বিড়াল নিয়ে! আমাদের সেসব শুনলে চলবে কেন। খুব কমসংখ্যক লোকজন আর সংগঠনই এগিয়ে আসে রাস্তায় আহত অবস্থায় পড়ে থাকা প্রাণীদের সুস্থ করে তোলার কাজে। সেই কমসংখ্যক সংগঠনের একটি হতে পেরে আমরা গর্বিত। কোথাও আহত প্রাণীর খোঁজ পেলেই অতি দ্রুত ছুটে যায় আমাদের উদ্ধারকারী দল।’
সাইমা ফেইরুজ সঙ্গে যোগ করলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই পর্দার আড়ালে থেকে আমরা কাজ করে আসছিলাম। বাড়িতে পোষা এবং রাস্তায় পড়ে থাকা অসহায় প্রাণীদের জন্য কাজ করি আমরা। এর লক্ষ্য, সবার মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, মানুষ ও পশুদের মধ্যে সহানুভূতিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। প্রাণীদের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা। সকল প্রাণের প্রতি মায়া ও সহানুভূতিশীলতা বৃদ্ধি করে প্রাণীদের প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন রোধ করা।’

উত্তম আশ্রয়
কেয়ার ফর পজ-এর ‘ফিল্ড অব অপারেশন’ বা আহত প্রাণী উদ্ধার কার্যক্রমের প্রধান সৌরভ শামীম। পেশায় তিনি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। আহত বিড়াল বা কুকুর উদ্ধারের বহু ঘটনা আছে তাঁর। ড্রেনের ময়লা পানিতে পড়ে মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া দুটি কুকুরছানাকেও তুলে এনেছেন শামীম।
প্রথম দিকের ঘটনা বলে, বুঝে উঠতে পারেননি কী থেকে কী করতে হবে। ফলে একটি ছানা টিকে গেলেও অপরটি মারা যায়। বেঁচে যাওয়া কুকুরের নাম রাখলেন সিজার। বড় হলে বোঝা যায় যে সে সংকর প্রজাতির কুকুর, অন্যসব দেশি কুকুর থেকে সে আলাদা।
উদ্ধারের পর স্বেচ্ছাসেবকদের নিজেদের বাসাই হয় আহত প্রাণীর আশ্রয় বা উত্তম আশ্রম।
গত ১৫ ডিসেম্বর গিয়ে এমনই আশ্রমের দেখা মিলল সৌরভ শামীমের বাসায়। সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠতেই ‘মিউ’ বলে অভ্যর্থনা জানায় একটি বিড়াল। ওর নাম জাদু।
ভেতরে বসার ঘরে বসতে না বসতেই উঁকি দিল ছোটন নামের আরেকটি বিড়াল। নাহ, সবগুলোকে এক পলক দেখার লোভ সামলানো গেল না! পাশের ঘরের দরজা খুলতেই দেখা গেল ঘরজুড়ে বিড়ালের রাজ্য—খাটের ওপর, খাটের নিচে, জানালার কার্নিশে, বারান্দাসহ সর্বত্রই বিড়ালের দখলে। মালিককে দেখে আদর কুড়ানোর জন্য দৌড়ে ছুটে এল।
এ ছাড়া কুকুরের জন্য ঢাকার গাবতলীতে ‘প’ (paw) এবং বিড়ালের জন্য নারায়ণগঞ্জে ‘এএলবি’ (এনিম্যাল লাভারস অব বাংলাদেশ) নামে আছে পৃথক দুটি আশ্রম। বর্তমানে ‘প’-তে ১৬টি কুকুর ও এএলবিতে ১০টি বিড়াল চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে।
সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে আশ্রম কর্তৃপক্ষ। নির্দিষ্ট সময় পরপর চিকিৎসা ও দেখভালের কাজটুকু করে কেয়ার ফর পজের স্বেচ্ছাসেবক দল।
বড় স্বপ্ন
স্বেচ্ছাসেবকদের নিজেদের প্রচেষ্টা আর অর্থায়নে চলছে আহত প্রাণীদের যাবতীয় চিকিৎসা ও খাবারের ব্যবস্থা।
সহ প্রতিষ্ঠাতা সাইমা ফেইরুজ জানান, ভবিষ্যতে মহাখালীতে একটি বহুতল পশু হাসপাতাল ও ২৪ ঘণ্টা সেবা প্রদানকারী ক্লিনিক বা চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্য আছে তাঁদের। আহত পশুকে দ্রুত চিকিৎসাক্ষেত্রে নেওয়ার জন্য থাকবে বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা।
ঢাকার পাশাপাশি সিলেট, চট্টগ্রামসহ পর্যায়ক্রমে সারা দেশে খোলা হবে প্রাণী চিকিৎসাকেন্দ্র। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় নির্দিষ্ট সময় পরপর টিকাদান কর্মসূচি চালু থাকবে সব সময়।
এই সংগঠনের সঙ্গে আরও নানাভাবে জড়িয়ে আছেন, তামজিদ করিম, আরেফিন রাফি, ফইয়াজ মুক্তাদির, অপর্ণা বাড়ৈ, মিলা মেহেরিনা, তারিকুল ইসলাম, নওশীন নূরসহ আরও অনেকে।
নতুন বছরের শুরুতে কেয়ার পর পজ দিচ্ছে আরও একটি সুখবর। মোহাম্মদপুরের বসিলাতে সংগঠনটির অফিস চালু হতে যাচ্ছে শিগগির।
কেয়ার ফর পজের ফেসবুক গ্রুপ www. facebook. com/groups/careforpaws/

যেকোনো প্রাণীরই বাঁচার অধিকার আছে
কে বি এম সাইফুল ইসলাম
চেয়ারম্যান, মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগ
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
যেকোনো প্রাণীরই পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার আছে। অথচ আমরা রাস্তায় কুকুর-বিড়াল দেখলেই তাড়িয়ে বেড়াই, আঘাত করি, এমনকি মেরেও ফেলি; যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেয়ার ফর পজ কাজ করছে এসব পথচারী বেওয়ারিশ প্রাণীদের নিয়ে। আর আমি যেহেতু প্রাণী চিকিৎসক, এরা যখন রাস্তা থেকে কোনো আহত কুকুর-বিড়ালকে উদ্ধার করে আনে, তখন আমার কাছে নিয়ে আসে।
আমি একটা নীতিতে বিশ্বাস করি যে এরা যদি কোনোভাবে প্রাণীবিষয়ক কোনো কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে এত কিছু করতে পারে, তখন আমি কেন ওদের সাহায্য করতে পারব না?