তিন দেশের তিন শহরে তিন রকম ঈদ

মেসিডোনিয়ার তেতোভো শহরের চিত্রিত মসজিদ
মেসিডোনিয়ার তেতোভো শহরের চিত্রিত মসজিদ

গত রোজার ঈদে কন্যা কাজরি আমাদের ছোট্ট একটি টি পার্টিতে দাওয়াত করেছে। বছর কয়েক ধরে আমি ও তার জননী হলেন বাস করছিলাম পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে। তাই অনেক দিন হলো মেয়ের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন হয়নি।

কাজরি এখন আছে সাভানা নদীর ওপারে, একটি ঘোড়ার খামারে। হর্স ফার্মে প্রদর্শনযোগ্য ঘোটকদের হেফাজতের জন্য অন্য লোকজন রয়েছে বটে, তবে কাজরি ঘোড়াগুলোর আলোকচিত্র তুলে দেওয়ার বিনিময়ে খামারে কাঠে তৈরি টালি ছাদের একটি ঘরে বসবাস করার সুযোগ পাচ্ছে।

আমি ও হলেন সেই হর্স ফার্মে এসে পৌঁছাই বিকেলের রোদ ম্লান হয়ে গুটিয়ে যাওয়ার সময়।

রোজার ঈদের দিন সবুজ ঘাসে ছাওয়া আঙিনায় টেবিল-চেয়ার পেতে টি পার্টির এন্তেজাম করেছে কাজরি। কুরুশ-কাঁটায় বোনা টেবিলক্লথের ওপর রাখা টি-পট ও সুগার-জারে পুরো পরিবেশ হয়ে উঠেছে জেইন অস্টিনের উপন্যাসের সেটিংয়ের মতো।

‘বাপি, টেল আস ঈদ স্টোরিজ। যে ঈদগুলো তুমি অন্য দেশে কাটিয়েছ, সেগুলোর গল্প বলো।’ চিত্রিত টি-পট থেকে পেয়ালায় দার্জিলিংয়ের সুগন্ধী চা ঢেলে দিতে দিতে কাজরির অনুরোধ।

বেশ কয়েকটি ঈদ পরিবারের সান্নিধ্য ছাড়া কাটিয়েছি কাবুলে। তাই আফগানিস্তান সম্পর্কে ঈদের কিস্‌সা বলার শুরুতেই সে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘নো স্যাড স্টোরি, নো নেগেটিভ ডেসক্রিপশন, বাপি।’

আমি কোশেশ করি কন্যাকে তার পছন্দ মোতাবেক একটি আখ্যান শোনাতে।

২০০৪ সাল। কুলুল্লা পুসতা নামে কাবুলের একটি কেল্লার কাছে বাস করতাম আমি। তখন কবি যশপ্রার্থী জনাকয়েক ছেলেমেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। এদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি সাহিত্যের ছাত্র তাজিক তরুণ মুখতার ইয়াকুবি। ঈদের দিন বিকেলবেলা তার সঙ্গে আমি ঘুরতে বেরোলাম। হাঁটতে হাঁটতে মুখতারের কাছ থেকেই জানলাম, ঈদের দিন আফগান কালচারে ঘর যতটা জরুরি, তার চেয়েও কবর বেশি গুরুত্ব পায়। আফগানরা রোজ রোজ মরহুমদের খোঁজ না নিলেও ঈদের দিন কবরগাঁয় কিন্তু একবার যাবেই।

কম্বোডিয়ায় রাজার অপেক্ষায় মক্তবের বালিকারা
কম্বোডিয়ায় রাজার অপেক্ষায় মক্তবের বালিকারা

মুখতারের সঙ্গে নগরীর বিরাট কবরস্থানের দিকে রওনা হলাম আমি। কবরগাঁয়ের প্রান্তিকে মোলাকাত পাওয়া যায় ফরাশ বিছিয়ে বসা গুচ্ছ গুচ্ছ বয়স্ক মানুষদের। এঁদের কেউ পান করছেন সবুজ চা, কোথাও দুজনে মুখোমুখি বসে সতরঞ্জের দান চালছেন, কেউ কেউ আলবোলায় দম দিয়ে বাতাসে ছুড়ছেন ধোঁয়া। আবার কোনো কোনো মানুষ পথচারীদের বিলাচ্ছেন মুঠো মুঠো কিশমিশ, পেস্তা ও বাদাম। কাছাকাছি বিক্রি হচ্ছে রঙিন বেলুন, বাচ্চারা ভেঁপু বাজিয়ে ছোটাছুটি করছে। ছোট্ট দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছে এক জোড়া শুভ্র কবুতর। ঈদ উপলক্ষে তারা ‘ঈদি’ বা উপহার হিসেবে পেয়েছে এই ‘সফেদ কাফতার’ বা শ্বেতকপোত।

ঈদের এসব গল্পে কাজরির মন ভরে না, ‘বাপি, ইয়োর ঈদ স্টোরি ইজ গেটিং স্ট্রেঞ্জ। অন্য কোনো দেশে ঈদ করার কথা বলো, যেখানে রাজা-রানিরা ঈদ সেলিব্রেশনে শামিল হন।’

‘নো প্রবলেম সুইটহার্ট, আমি কম্বোডিয়ার নমপেনে ঈদ পালনের গল্প বলছি। আই উইল ফাইন্ড আ কিং...লিসেন।’

অনেক বছর আগের কথা। কম্বোডিয়ান ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে কাজ করতাম। ঈদের দিন ‘নুরুননাইম মসজিদে’ নামাজ আদায় করলাম। কম্বোডিয়ার মুসলিম সংখ্যালঘু চাম সম্প্রদায়ের এ মসজিদের ইমাম ইয়াম মেহসামের আমার পূর্বপরিচিত। তবে নামাজ পড়ার পর জানতে পারলাম, ইমাম মেহসাম উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে অসুস্থ। তাই মসজিদে জামাত পড়াতে আসেননি। চাম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঈদের দিন হামছায়া বা সম্প্রদায়ের রুগ্‌ণ মানুষজনকে দেখতে যাওয়ার রেওয়াজ আছে। তাই মসজিদের দুই মুসল্লির সঙ্গে আমি হাজির হলাম তাঁর বাড়িতে। খুঁটির ওপর কাঠের তৈরি চারচালা ঘর। লুঙ্গি পরা অসুস্থ ইমাম আমাকে দেখে এত খুশি হলেন যে হাতের কবজি চেপে ধরে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর জোরাজুরি করলেন একত্রে দুমুঠো ভাত খাওয়ার জন্য। খাবার পরিবেশনের অপেক্ষার ফাঁকে আমরা চাম সম্প্রদায় সম্পর্কে টুকটাক কথা বললাম। চামরা আদিতে ছিল ভিয়েতনামের চম্পা রাজ্যের বাসিন্দা। ওই দেশের প্রজারা প্রথম দিকে ছিল হিন্দু, পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে অনেকে। আরব বণিকদের প্রভাবে কিছু চাম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের জন্য চম্পা রাজ্যে বসবাস কঠিন হয়ে পড়ে। ধর্মীয় নিপীড়নে দেশত্যাগ করে তারা আশ্রয় নেয় পাশের দেশ কম্বোডিয়ায়।

বেতের ট্রেতে করে পরিবেশিত হলো ভাতের সঙ্গে মুরগি আর মাছের ঝোল, বাঁশের কোরলের সালাদ এবং কলাপাতায় মোড়ানো তালশাঁসের পিঠা। খাওয়ার পর আমাকে অ্যালবামের কিছু ছবি দেখালেন ইমাম। আলোকচিত্রে দেখা গেল, ইমামের নেতৃত্বে চাম সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রাসাদে রাজা নরোদম সিহানুকের হাতে ঈদের দিন তুলে দিচ্ছেন সারং বা সাদা লুঙ্গি, তকিয়া বা টুপি, তালশাঁসের পিঠা ও আগরবাতি। আরেকটি ছবিতে হাত জোড় করে প্রণামরত বৌদ্ধ রাজা সিহানুকের শিরে ইমাম পরিয়ে দিচ্ছেন একটি তকিয়া। এভাবে অ্যালবাম দেখাতে দেখাতে আফসোস করলেন ইমাম, ‘শরীর খারাপের কারণে এবার রাজপ্রাসাদে যেতে পারিনি, তবে অন্য এক ইমামের নেতৃত্বে চাম সম্প্রদায়ের মানুষজন রাজদর্শনে বিকেলে জড়ো হবেন রাজপুরির প্রাঙ্গণে।’

কাবুলে শিশুদের ঈদ উপহার শ্বেতকপোত
কাবুলে শিশুদের ঈদ উপহার শ্বেতকপোত

বিদায় নিয়ে নমপেনে ফেরার পথে আমি প্যালেস কম্পাউন্ডে গাড়ি পার্ক করি। নদীতীরের মাঠে গুচ্ছ গুচ্ছ হয়ে বসে আছে চাম কৌমের মানুষেরা। কথা আছে, রাজা সিহানুক বেরিয়ে এসে প্রাসাদের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দর্শন দেবেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমিও চাম সম্প্রদায়ের ঈদের দিনে রাজসান্নিধ্যে হাজিরা দেওয়ার রেওয়াজ নিয়ে ভাবি। একটু আগে ইমামের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে কম্বোডিয়ায় এলে রাজার পূর্বপুরুষেরা আশ্রয় দেন চামদের, বিধিনিষেধ ছাড়া ইসলাম ধর্ম চর্চার অধিকার দেন। সেই থেকে চালু হয়েছেÑঈদের দিন প্রাসাদের বেলকনির তলায় দাঁড়িয়ে রাজদর্শনের। এদিক-ওদিক একটু হাঁটাচলা করি আমি। দেখতে পাই, মক্তবের রাজার অপেক্ষায় রঙিন ছাতি মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ছোট বালিকারা। সময় যায়। কিং সিহানুক এখনো বেলকনিতে এসে দাঁড়াননি। প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে এ রাজার অপেক্ষায় আমি হাড়ে হাড়ে ভাজা হতে চাই না। তাই স্রেফ ফিরে এলাম হোটেলে।

কাজরি তস্তরিতে টি-কেক তুলে দিতে দিতে মন্তব্য করে, ‘দ্য কিং হ্যাজ আ বিহেভিয়ারেল প্রবলেম। মানুষজনদের দাঁড় করিয়ে রেখেছে রোদের মধ্যে। আই ডোন্ট লাইক দিস স্টোরি। অন্য একটা ঈদের গল্প বলো। টেল মি দ্য স্টোরি অব আ মোস্ট বিউটিফুল মস্ক ইউ এভার ভিজিটেড ফর ঈদ।’

উৎসাহিত হয়ে জবাব দিলাম আমি, ‘দ্যাট ইজ ইজি হানি। মেসিডোনিয়ার তেতোভো শহরে ঈদ করেছি। এবার সেই গল্প শোনো।’

তেতোভো শহরের যে সুদর্শন মসজিদে আমি ঈদের নামাজ আদায় করি, তার নাম ‘সারেনা জামিয়া’ বা চিত্রিত মসজিদ। ১৪৩৮ সালে মশহুর তুর্কি স্থপতি ইসহাক বে এটি নির্মাণ করেন। পরবর্তী জামানায় তেতোভো অঞ্চলের অটোমান শাসক আবদুর রহমান পাশা ১৮৩৩ সালে নতুন করে সংস্কার করান এ মসজিদটি। ইমারতটির বাইরের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে সিরামিকের চিত্রিত টাইলসে। ভেতরের স্তম্ভ, দেয়ালগিরি, ছাদ ও মেহরাবে আঁকা বর্ণাঢ্য চিত্ররাজি দর্শকদের পৌঁছে দেয় চেতনার এক সম্মোহনী স্তরে। নিরিখ করে তাকালে মনে হবে, Ñহরেক বর্ণের ছায়া গোধূলির আকাশে ভাসমান মেঘের মতো তৈরি করছে চলমান জীবনের গতি। চিত্রকরের কারুকাজে বিচিত্র বর্ণের ব্যবহার, তা সৃষ্টি যে আদতে রঙের সমাহার, সে কথা মনে করিয়ে দেয়।

নামাজান্তে কোলাকুলি ইত্যাদির পর মুসল্লিরা যে যার বাড়িতে ফিরে গেলেও আমি চিত্রিত মসজিদের বারান্দায় বসেছিলাম, একাকী। ছাদ ও দেয়ালগিরির রঙিন নকশাবৈচিত্র্য আমার ভেতরে ছড়িয়েছিল দিব্য আবেশ। এ সময় দেখলাম, আঙিনার গোলাপবাগে জড়ো হয়েছে কয়েকজন কিশোর-কিশোরী। তারা বাগিচার ভারী পাথর সরিয়ে তার নিচে রাখছে চিরকুটের মতো একখানা কাগজ। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, আবদুর রহমান পাশার কিশোরী কন্যা আওরোরা বেসজানা গোলাপবাগের একটি পাথরে বসে দেখত মসজিদ সংস্কারের কাজ। আফতাব আফেন্দি বলে এক চিত্রকরের পেশিবহুল হাতে আঁকা নকশা তার চোখে ছড়িয়েছিল জাদুময়তা। আফেন্দিকে কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছিল না আওরোরা। তো, ঈদের দিন সে চিরকুটে একটি কবিতার স্তবক লিখে গুঁজে দেয় পাথরের তলায়। আফেন্দি ঠিকই বুঝতে পেরেছিল আওরোরার ইঙ্গিত। সন্ধ্যার দিকে আওরোরা ফের পাথরের কাছে এলে বুঝতে পারল, তার চিরকুটটি কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে ওখানে ভিন্ন কাগজে চিত্রিত নকশায় লিখে দিয়েছে অন্য একটি কবিতার কয়েকটি চরণ। এ থেকে তেতোভো শহরের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ঈদের দিন কবিতা লিখে পাথরের তলায় রাখাটা রেওয়াজ হয়ে উঠেছে।

এ গল্পে স্পষ্টত খুশি কাজরি। এতক্ষণে সে বলল, ‘দিস ওয়ান ইজ হার্ট ওয়ার্মিং অ্যান্ড গুড, বাপি।’ টি-পট তুলে নিয়ে চা গরম করতে কিচেনে গেল সে। আমি দেখলাম, খামারের গাছে ঝোলানো কৃত্রিম নীড়ে নীড়ে ফিরে আসছে পাখিরা—এ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে ভাবি, পারিবারিক মিথস্ক্রিয়ায় ভরপুর এ ধরনের আরেকটি ঈদ ফের আমাদের জীবনে আসবে কি?