তুমি একটা আজব

আঁকা: রাজীব
আঁকা: রাজীব

আমার ঘোরতর বিপদ। এই বিপদের কথা ছোট ফুপুর কানে পৌঁছাবে না আর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই ফুপাকে বগলদাবা করে হন্তদন্ত হয়ে তিনি হাজির হবেন না—এটা চিন্তা করাই দোষের! ছোট ফুপু আমার দেখা দুনিয়ার সবচেয়ে বোকা, ভয়ংকর আর দয়ার্দ্র নারী। আমাদের গোষ্ঠীতে আন্ত পারিবারিক ঝুট-ঝামেলায় পরামর্শক হিসেবে কাজ তো করেনই, চড়-থাপড় দেওয়ার মতো ব্যাপারগুলোও দায়িত্বসহকারে পালন করেন তিনিই।

ফুপুকে আমি ঘটনার আদ্যোপান্ত খুলে বললাম। সামান্য ভুল-বোঝাবুঝি থেকে কথা-কাটাকাটি এবং তারপর ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে সাদিয়ার কচুক্ষেত, তার বাপের বাড়িতে চলে যাওয়া এবং ভুল যে বেশি আমারই ছিল—এ টু জেড সবই।

ঘটনা শুনে ফুপু একটা বিরাট দম নিলেন। খানিকক্ষণ ইতিউতি তাকিয়ে-টাকিয়ে থেকে গলা একটুখানি নামিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, বাসর রাতে ওই কাজটা ঠিকঠাকমতো করেছিলি তো?’

লজ্জায় আমার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। বলেন কী ফুপু! আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন কাজটা?’
‘কোন কাজটা!’ ফুপু ভেংচি দিয়ে কথাটা বললেন, ‘বেকুবের গুষ্টি সব। পানিতে গুলে সব কথা গিলিয়ে দিতে হয় তোমাদের। এক কথা এক শ বার বলতে গেলে এত রাগ লাগে!’

একদমে কথাগুলো বলে গলা খানিকটা চড়িয়ে এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরে, তোরে যে বলছিলাম, বাসর রাতে বিড়াল মারতে, মারছিলি?’

আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বিড়াল মারার কথা শুনে খানিকটা নস্টালজিকও হয়ে গেলাম। আহা! কী একটা রাত ছিল!

‘ক্যাবলার মতো তাকিয়ে আছিস কেন! আমি কী জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে।’ ফুপুর গলার ঝাঁজে নস্টালজিয়া ছুটে গেল। ফুপু আবার ভুরুটুরু কুঁচকে, নাক-মুখ নাচিয়ে জেরা করার ভঙ্গিতে ‘কাজের’ কথা জিজ্ঞেস করলেন।

মাঝারি আকারের একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। কী বলব এখন! কোন কবিতায় নাকি কোথায় জানি পড়েছিলাম, ‘আমায় একটা আকাশ দে রে ক্যাবলা হয়ে তাকিয়ে থাকি!’ ফুপু যে প্রশ্ন করেছেন তাতে আমার চোখে-মুখে খানিকটা উদাস উদাস ভাব এনে এখন তেমনই কিছু একটা করা উচিত।

একটু সাহস নিয়ে ফুপুর দিকে কোনাকুনি তাকিয়ে বেশ কায়দা করে বললাম, ‘মারছি না আবার!’

আমার ‘মারছি না আবার’ শুনে ফুপু খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। কী একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গিয়ে একটু পর শুধু বললেন, ‘ও!’

একটু দম নিয়েই ফোঁস করে বলে উঠলেন, ‘ঠিকই আছে। একদম উচিত কাজ হইছে।’ তারপর যথাক্রমে আমার ও ফুপার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘তোরা পুরুষের গুষ্টি সব এক! বদের বদ একেকজন!’ এতক্ষণ নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকা ছোট ফুপা ‘সরব’ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। এহেন পরিস্থিতিতে পুরুষের গোষ্ঠীতে আমার সঙ্গে তাঁকেও এক কাতারে রাখায় বেচারা খানিকটা আহত হলেন মনে হলো!

আমাদের পুরুষের গোষ্ঠীকে বকাঝকা করে ফুপু এবং খানিক বাদেই ফুপা চলে যাওয়ার পরই আমার মনটা গত তিন দিনের মতো আবারও সাদিয়ার জন্য কেমন করে উঠল! বিয়ের আগে-পরে মিলিয়ে সাত-সাতটা বছরের প্রেম আমাদের! অভিমানী মেয়েটাকে বিয়ের পরও বউ বউ মনে হয় না। এখনো আমার কাছে ওকে প্রেমিকার মতোই লাগে! কিন্তু ও এমন হ্যাবলা যে আমার প্রেমটেম তেমন বোঝেই না! আস্ত একটা আজব!

উথাল-পাথাল প্রেমের ভাবনার মধ্যেই ছোট ফুপু এসে হাজির হলেন। খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ঝটকা মেরে বললেন, ‘ওঠ!’

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই কাঠ-কাঠ গলায় বললেন, ‘কচুক্ষেত যাব।’

ফুপুকে পা ছুঁয়ে সালাম করার অদম্য ইচ্ছা দমন করে কিছুটা গাঁইগুঁই করার ভান করলাম! বললাম, ‘এত রাতে?’

ফুপু ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে আমার গাঁইগুঁইয়ের চৌদ্দ দুগুণে আটাশ গোষ্ঠী উদ্ধার করে দিলেন! সাজুগুজু করে, ফুলবাবুটি সেজে সিঁড়ি দিয়ে নামছি আর এক শ কথা ভেবে চলেছি। সাদিয়ার মুখোমুখি হলে লজ্জায় মুখ কতটা লাল হবে, কী কথা তাকে বলব, কী কথা দিয়ে কথা শুরু করব—ভাবতে ভাবতে কখন যে আনমনা হয়ে গেলাম, খেয়ালই ছিল না! নিচ থেকে ফুপুর ভারী গলার আওয়াজে সংবিৎ ফিরে পেলাম। তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে যা দেখলাম তাতে মনটা কেমন করে উঠল, বুকটা কেঁপে উঠল! ‘কী যে ভালো লাগল আমার’-টাইপের আজব এক অনুভূতি হলো! ফুপুর সঙ্গে হাসি হাসি মুখ করে সে দাঁড়িয়ে আছে! আমার দিকে চোখ পড়তেই বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘গেটে সিএনজিঅলা দাঁড়িয়ে আছে। ভাড়াটা দিয়ে আসো তো। ২৮০ টাকার কথা বলে এসেছি!’

আমি মেইল ট্রেনের মতো বিশাল একটা সুখের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললাম, ‘তুমি একটা আজব!’