‘তোমাকে ছাড়া দ্বিতীয় বর্ষে উঠব না’

ভালোবাসার গল্প আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। বিপুল সাড়া দিয়েছেন পাঠক। কেউ লিখেছেন দুরন্ত প্রেমের গল্প, কেউবা শুনিয়েছেন দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়ার অনুভূতি। বাছাই একটি গল্প রইল এখানে।

ডিপার্টমেন্টে বন্ধুরা আমাদের ‘সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ’ বলে ডাকে। রুপা ও রিপা সমবাহু আর আমি সাকিব বিষমবাহু। রিপা আরও সংক্ষেপে বিষম বলে ডাকে। আমি ওদের পারু ও পরি ডাকি।

ব্যবহারিক ক্লাস ও শৈবাল সংগ্রহের জন্য একদিন ক্লাসে উপস্থিত সবাইকে নিয়ে দল গঠন করা হয়। পছন্দের প্রতি চারজন মিলে দলগুলো গঠিত হয়। সেদিন আমরা তিনজনই অনুপস্থিত ছিলাম। পরের ক্লাসে স্যার আমাদের নিয়ে একটি দল গঠন করে দিলেন। বন্ধুরা আমাকে ভাগ্যবান বলে দুষ্টুমি করত। রিপা সুন্দরী এবং স্মার্ট মেয়ে। শনিবার ব্যবহারিক ক্লাসের দিন ছাড়া যত দূর সম্ভব আমাকে এড়িয়ে চলত এ দুষ্টুমির কারণে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য দীর্ঘদিন ক্লাস করিনি। রুপা সাহায্য করত পুরোনো ক্লাসগুলো বুঝতে। সেমিনারে বই নিয়ে থাকি প্রতিদিন। স্যারদের ক্লাসের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিই, প্রশ্ন করি। কদিনেই ক্লাসে সুনাম বেড়ে গেল। রিপা ভেবেছিল আমি বাউন্ডুলে, তাই এত দিন ক্লাস করিনি। সে প্রস্তাব দিল প্রাইভেট পড়ার জন্য। পড়ব না শুনে মন খারাপ করে বলল, ‘ও, তুমি তো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট!’ আমি জানালাম, লাইব্রেরি থেকে অনেক লেখকের বই পড়ে নোট করছি। রিপা বলল, ‘তাই নাকি? আমাকে কিন্তু তোমার নোটগুলো দিয়ো।’ বললাম, লাইব্রেরিতে এসো প্রতিদিন।

পরদিন লাইব্রেরিতে সে একটা চুইংগাম দিল। তারপর প্রতিদিনই চকলেট না হয় চুইংগাম। ক্লাস শেষে গেটে দাঁড়িয়ে থাকত। রুপা আমার খসড়া লেখাগুলো গুছিয়ে লিখে দিত। রিপা দুষ্টুমি করে, লিখতে চায় না। রিপা আমাকে বাধ্য করে তার ব্যবহারিক খাতা লিখে দিতে। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বাড়ি গিয়ে থাকি অনেক দিন। রিপা চিঠি লিখেছে বাড়ির ঠিকানায় ফরমালিনে তার লাগানো গাছের প্রথম আম রেখে দিয়েছে, আমি ফিরলে একসঙ্গে সে এ আম খাবে।

তত্ত্বীয় পরীক্ষা শেষে প্রস্তুতিমূলক ব্যবহারিক ক্লাস চলছে। রিপার পক্স হয়েছে, তাই সে ক্লাস করতে পারছে না।

রূপা আর আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমি ওর বাসায় গিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তোমাকে ছাড়া দ্বিতীয় বর্ষে উঠব না। সে আমাকে ঢুকতে নিষেধ করল। বলল, ‘সংক্রামক রোগ, তোমারও হবে।’ আমি বললাম, বেশ তো হোক। তুমি একাই কেন কষ্ট করবে? সব খাতা আমি করে দেব, সব কালেকশন গুছিয়ে দেব। ওর মা–বাবা খুব খুশি হলেন।

কয়েক দিন ওর বাসায় যেতে হলো। আমি গেলে সে–ও পাশের কক্ষ থেকে পর্দা সরিয়ে দেখে আমার কাজ। গল্প করে। ওর মা–বাবা ব্যাংকার। বাসায় ফেরেন সন্ধ্যার পর। আমি থাকি বিকেল পর্যন্ত। আমার সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে রাখে রিপার হাসি, দুষ্টুমি। রাতে ভালো ঘুম হয় না। প্রতি রাতে তাকে স্বপ্ন দেখি। পরদিন রিপাকে লজ্জায় বলা হয় না।

সে অনেকটাই সুস্থ। শেষের দিনটায় সে একটা গোলাপ ফুল দেয়। ওর হাতটা লেগে থাকে আমার হাতে। ওর হাসিমাখা মুগ্ধ দৃষ্টি স্থির হয়ে ভাসে আমার চোখে। আমি পথ ভুলে অন্য পথে চলে যাই। মেসের বাজার করতে গিয়ে বাজার ছাড়িয়ে চলে যাই। পরীক্ষার দিন ভোরে পেটে ব্যথা অনুভব করি। ব্যথার তীব্রতা বাড়ে এবং প্রচুর বমি হতে থাকে। ব্যথা না কমায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। নানান পরীক্ষায়ও কোনো কারণ উদ্‌ঘাটিত হয় না।

আমাকে পরীক্ষার হলে না দেখে রিপা অস্থির। রিকশা নিয়ে আমার মেসে এসে শুনে যে আমি হাসপাতালে। পরীক্ষা বাদ দিয়ে হাসপাতালে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বললাম, তুমি পরীক্ষা দাওনি?

রিপা না–সূচক মাথা নাড়ল। বললাম, কেন! বলল, ‘তোমাকে ছাড়া দ্বিতীয় বর্ষে উঠব না।’

আমার দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ