ত্যাগ

মা গরুটিকে শাড়ির আঁচল দিয়ে শরীর মুছে দিচ্ছেন আর গলা জড়িয়ে কী যেন বলছেন। মায়ের আদরে গরুটি আরামদায়ক আলস্যে চোখ বন্ধ করে আছে। বাবা মাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘আর কত আদর করবা! তোমার প্রতিদিন একই কাণ্ডকারখানার কারণে গরুটি বিক্রি করতে পারছি না। গরুর প্রতি যদি এতই ভালোবাসা তাহলে টাকা দাও, আমি গরু বিক্রি করব না।’

মা কোনো জবাব না দিয়ে তার মতো গরুটির গলায় হাত বুলাচ্ছেন। গরুটি আমার নানি মাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। দুবার বাচ্চা দেওয়ার পর আর বাচ্চা দেওয়ার সম্ভাবনা নাই। আর ঈদের পরই বোনের বিয়ে। তার বিয়েতে বরপক্ষের দাবিকৃত টাকা দিতেই বাবা গরুটি বিক্রি করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এখন বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যাবে। ঈদের পর হয়তো কেউ আর এই গরু কিনতে চাইবে না। প্রতিদিন গরুটির সেবা-যত্ন করতে করতে গরুটির প্রতি মায়ের এক ধরনের মায়ার জন্মেছে। তাই হয়তো মা গরুটির প্রতি তাঁর মায়া ছাড়তে পারছেন না।

কোরবানির ঈদের আর দুদিন বাকি। সবাই গরু কেনায় ব্যস্ত আর আমরা গরুটি বিক্রি করতে পারছি না। কেউ কেউ দেখি গরু কিনে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন। অনেকে গরুর দাম বলার জন্য সঙ্গে করে একজন লোক নিয়ে এসেছেন। কোরবানির গরু কিনে বাড়ি ফেরার পথে অনেকেই গরুর দাম জিজ্ঞেস করেন। অনেক লোকের কাজই হলো গরুর দাম জিজ্ঞেস করা আর এর উত্তর জানতে পেরে এক ধরনের আনন্দ অনুভব করা। একটা গরুর সঙ্গে অনেক লোক থাকায় অনেক সময় দাম বলা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। দেখা যায়, সবাই একসঙ্গে দাম বলেন, আবার অনেক সময় কেউই দাম বলেন না। এই বিভ্রান্তি দূর করতে দাম বলার জন্য একজন লোক নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে আমরা গরুটি বিক্রি করতে না পেরে প্রতিদিন গরু নিয়ে হাটে যেতে-আসতে হাঁপিয়ে উঠেছি। আসার সময় অনেকেই মনে করে আমরা গরু কিনে এনেছি। তাই তারা অভ্যাসবশত জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাই, দাম কত?’ প্রশ্নটি শোনার পর আমার যে কী আনন্দ হয়, তা বলার মতো না! তখন নিজেকে ধনী শ্রেণির একজন মনে হয়।

আজ আবারও গরু নিয়ে হাটে রওনা দিচ্ছি। কিন্তু প্রতিবারের মতো মা গরুকে আদর করতে ব্যস্ত। মায়ের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয়, এটা গরু না মায়ের সন্তান! আমাদের মা যেভাবে আদর করেন গরুটাকে ঠিক সেভাবেই আদর করেন। আর গরুটাও মায়ের হাত ছাড়া মাঝে মাঝে কিছুই খায় না।মায়ের চোখে পানি। বিয়ের পর একটা মেয়েকে বাপের বাড়ি থেকে যেভাবে মায়েরা কেঁদে বিদায় দেয়, মা ঠিক সেভাবেই কাঁদছেন। বাবার ধমকে আমি এগিয়ে গিয়ে মায়ের হাত থেকে গরুর দড়িটা নিলাম। বাবাকে রাগতে দেখে আমার বোন এসে বলল, ‘বাবা, আমাকে বিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। আমার জন্যই তো গরু বিক্রি করতে হচ্ছে।’ মা এসে বোনকে বলল, ‘ও কথা বলিস না। এমন ছেলে আর পাব না। তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমাদের আর চিন্তা নেই।’ আমি আর বাবা কথা বাড়ালাম না। গরু নিয়ে হাটের দিকে রওনা দিলাম।

গরুটির প্রতি মায়ের এত মমতার কারণ হলো, গরুটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানির স্মৃতি। যেটাকে আশ্রয় করে মা বেঁচে আছেন। মাঝেমধ্যে দেখতাম মা গরুটির গলা জড়িয়ে কী যেন বলছেন। নিজে নিজেকে প্রশ্ন করতাম, মা কি গরুর কথা বুঝে? বিজ্ঞান বলে পশুর প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার ফলে একসময় টেলিপেথিক পদ্ধতিতে যেকোনো পশুর সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব। মা হয়তো টেলিপেথিক পদ্ধতিতে গরুটির সঙ্গে কথা বলে। আজ আর আমাদের হাটে এসে ফেরত যেতে হলো না। একজন ভালো ক্রেতা পেয়ে গেলাম। তিনি বাবার পরিচিত। আমাদের পাশের গ্রামেই তাদের বাস। তিনি এসে বাবাকে বললেন, ‘আপনাদের গরুটি গাভি হলে কী হবে! দূর থেকে বলদের মতোই লাগে। এটা আবার গর্ভবতী নয়তো?’ বাবা জবাব দিলেন, ‘না না। একি বলেন! গর্ভবতী গরু কোরবানি দেওয়া যায় না, সেটা আমি জানি।’

ক্রেতা আর কথা বাড়ালেন না। গরুটির দাম নির্ধারণ করে বললেন, ‘গরুটি বাড়িতে নিয়ে যান। আগামীকাল আমার লোক দাম পরিশোধ করে গরু নিয়ে আসবে।’ তাঁর কথায় আস্থা রেখে আমরা গরু নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। মা আগেই আমাদের পথ চেয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি মুখে যতই বলুন গরুটি বিক্রি করা হোক, অন্তরে চাচ্ছেন না আমরা গরুটি বিক্রি করি। আমাদের ফিরতে দেখে মা এগিয়ে এসে গরুটির গলা জড়িয়ে চুমু খেলেন। বাবা মাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘যত আদর করার আজই করে দাও। আগামীকাল লোক এসে টাকা দিয়ে গরু নিয়ে যাবে।’ এই কথা শোনার পর মায়ের চেহারা অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এখনই তিনি কেঁদে দেবেন।

পরদিন গরুর ক্রেতা হারুন চাচা টাকা পরিশোধ করে গরু নিতে এলেন। মা আজ গরুটিকে সুন্দর করে সাজিয়েছেন। এর শিং কালো রঙে রাঙিয়েছেন, গলায় ফুলের মালা আর নতুন দড়ি দিয়ে বেঁধেছেন। গরুটির প্রতি মায়ের এত মমতা দেখে হারুন চাচা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি মাকে বললেন, ‘ভাবি, আপনি গরুটিকে খুবই ভালোবাসেন, তাই না?’ মা কিশোরী মেয়েদের মতো ছলছল চোখে ওপর থেকে নিচে মাথা হেলিয়ে সায় দিলেন। হারুন চাচা মায়ের হাত থেকে গরুটির দড়ি নিতে গেলে মা তাঁর হাতে দড়িটি দিয়ে কেঁদেই ফেললেন। হারুন চাচা মাকে বললেন, ‘কাঁদবেন না ভাবি। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে আপনার প্রিয় গরুটি কোরবানি দিতে যাচ্ছি। কোরবানি মানেই তো প্রিয় বস্তু ত্যাগ। আমার কোরবানির সওয়াবের ভাগীদার আপনিও হবেন।’

মা কাপড়ের আঁচলের এক কোনায় চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, ‘এটা শুধু গরু না। আমার সন্তানও। আমার স্বামী যখন অসুস্থ ছিল তখন এর দুধ বিক্রির টাকাতেই আমরা বেঁচে ছিলাম। আজ যদি মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দিতে না হতো, তাহলে আমি কখনোই সন্তানকে বিক্রি করতে দিতাম না।’ মায়ের কথা শুনে উপস্থিত সবার চোখেই পানি এসে গেছে।

হারুন চাচা গরু নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই মা মনমরা হয়ে বসে আছেন। পানি ছাড়া কিছুই খাচ্ছেন না। তাঁর চেহারা দেখে যে কেউ বলবে, হয়তো পরিবারের কারও মৃত্যুতে মা শোক পালন করছেন। বাবা মাকে বোঝাতে গিয়ে কিছু বলতে পারলেন না। আমিও মায়ের পাশে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। কিন্তু তাঁর চেহারা দেখে কিছু বলতে পারলাম না।

ঈদের দিন ভোরে মায়ের কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে বাইরে গিয়ে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী করব বুঝতে পারছি না। একি দেখছি, এটা কি স্বপ্ন নাকি বাস্তব! মনে হচ্ছে আমি স্বপ্নের রাজ্যে বাস করছি। একি সম্ভব! আমাদের গরুটি উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। আর মা গরুটির গলা জড়িয়ে কাঁদছে, মায়ের সঙ্গে গরুটিও কাঁদছে। তার দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে। আমি, বাবা আর বোন মায়ের পাশে হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। আমার বুঝতে বাকি রইল না গরুটি গলার বাঁধন ছিঁড়ে পালিয়ে এসেছে। তার গলার ছেঁড়া দড়ির চিহ্ন দেখেই তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

এর কিছুক্ষণ পরই হারুন চাচা গরুর খোঁজে আমাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। মায়ের শোকার্ত চেহারায় খুশি আভাস দেখে হারুন চাচা বললেন, গোয়াল ঘরে দড়ির ছেঁড়া অংশ দেখেই বুঝতে পারছি গরুটি এখানে এসেছে। বাবা বললেন, ভাই এটা কীভাবে সম্ভব? হারুন চাচা বললেন, আপনার গরুটি গন্ধ শুঁকে শুঁকে এখানে এসে হাজির হয়েছে।

হারুন চাচা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ভাবি, কোরবানি মানে শুধু পশু জবাই নয়। মনের পশুত্বও কোরবানি করা। আমি গরু ও টাকা দুটোই আপনাদের দিয়ে গেলাম।’ ওনার কথা শুনে আমাদের সবার চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগল। তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের পানি লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, ‘প্রতি বছরই পশু কোরবানি দিই। এবার না হয় আপনাদের খুশির জন্য এই ত্যাগ করলাম।’ আমরা কিছু বলতে পারলাম না। মহান ব্যক্তিটির দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।