দিন ফুরাল স্লেট-চকের!

দিন ফুরাল স্লেট–চকের
দিন ফুরাল স্লেট–চকের

আয়ান হালিম। বয়স আড়াই বছর। গত সপ্তাহে হাতেখড়ি হয়েছে তার। বাবা আবদুল হালিমের ইচ্ছে ছিল ‘স্লেট-চকে’ ছেলের হাতেখড়ি করাবেন। কিন্তু সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। আক্ষেপ করে বললেন, ‘যেখানে থাকি সেখানকার দোকানগুলোয় স্লেট পাওয়া গেল না। নীলক্ষেতে গিয়ে খুঁজলে পাওয়া যেত। কিন্তু সময়ের অভাবে যেতে পারিনি।’ তিনি থাকেন রাজধানীর গোড়ানে।
একটা সময় ছিল যখন নবীন শিক্ষাথীর হাতেখড়ি মানেই ছিল গুরুজনের হাতে হাত রেখে স্লেটের ওপর চক-পেনসিল দিয়ে লিখতে শেখা। আরও কিছুটা বড় হয়ে লিখতে হতো ফাউন্টেন পেন দিয়ে। কিন্তু সেই স্লেট-চক, ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার ততটা আর নেই। বর্তমানে খাতা-কলমের দোকানে খুঁজে পেতে কষ্ট হয় একসময়ের অত্যাবশকীয় এসব শিক্ষা উপাদান।
সেকেলে স্লেট-চকের স্থান দখল করে নিচ্ছে আধুনিক উপকরণ। ভারী, ভঙ্গুর স্লেটের স্থান নিয়েছে পলকা কাগজ। বাজারে পাওয়া যাচ্ছে কার্বনের পর্দা লাগানো ‘ডিজিটাল’ ম্যাজিক স্লেট। সব ধরনের কাগজে লেখা যায়, বারবার কালি বদল করতে হয় না বলে ফাউন্টেন পেনের বদলে এখন বলপয়েন্ট কলমেই সবার আস্থা। আর কম্পিউটার তো আছেই।
ঢাকার একটি নামী স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। ফাউন্টেন পেনের নাম শুনলেও সেটি দেখেনি তাদের অনেকেই, ব্যবহার করা তো দূরের কথা। তাদের কারও হাতেখড়ি স্লেট-চকে হয়নি। এই সময়ের শিক্ষার্থীদের সবারই কমবেশি এ অবস্থা। তবে স্লেট-চক ব্যবহার করে এমন কিছু শিক্ষার্থী এখনো আছে। ছিন্নমূল শিশুদের শিক্ষা দেয় এমন কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বস্তিবাসী শিক্ষার্থীদের তারা স্লেট-চকে লেখা শেখায়। এদের বেশির ভাগের পরিবারেরই খাতা কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই বলে স্লেটই ভরসা।
ফাউন্টেন পেন বা ঝরনা কলম, কালির কলম নামেও পরিচিত। উৎপাদন শুরু ১৮৮৪ সালের দিকে। উদ্ভাবক হলেন মার্কিন লে ই ওয়াটারম্যান। আর পৃথিবীজুড়ে বলপয়েন্ট কলম ব্যবহার শুরু হয় ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে।
অনেকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এখনো ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করেন। যদিও এঁদের সংখ্যা খুবই সীমিত। শৌখিন কবি-সাহিত্যিকদের কেউ কেউ লেখালেখির কাজ করেন এ কলম দিয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘উপহার বা পুরস্কার হিসেবেও একসময় দেওয়া হতো ঝরনা কলমের সেট। ১৯৬৩ সালে একবার প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পেয়েছিলাম। তাই স্কুলের শিক্ষকেরা মিলে শের্ফাসের ফাউন্টেন পেন সেট উপহার দিয়েছিলেন। তা আমার বাবাকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলাম। স্লেট-চক দিয়ে প্রাইমারি পর্যন্ত লিখেছিলাম। তারপর লিখতাম পেলিকেন, পাইলট বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঝরনা কলম দিয়ে। এসব কলম ছিল দামি।’
ঢাকার নিউর্মাকেট, নীলক্ষেত, শাহবাগের আজিজ মার্কেট, অভিজাত এলাকার কয়েকটি খাতা-কলমের দোকানে এখনো পাওয়া যায় স্লেট, ফাউন্টেন পেন ও এর কালি। উইনসন ব্র্যান্ডের ফাউন্টেন পেন পাওয়া যায় সর্বনিম্ন ৬০ টাকায়। ৪০০-৫০০ টাকায় ভালো ফাউন্টেন পেন পাওয়া যায়। নীলক্ষেতের দোকানগুলোতে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন হাজার টাকা মূল্যেরও ফাউন্টেন পেন রয়েছে।
কালির মধ্যে বাংলাদেশি ব্র্যান্ড হিরো পাওয়া যায় ৬৫ টাকায়, জার্মানির পেলিকেন ২৫০ টাকা, জাপানের পাইলট কালি ৩৫০ টাকা।
প্লাস্টিকের স্লেট পাওয়া যায় ২০ টাকায়। কাঠের এবং পাথরের স্লেট ৩০ টাকা। একটি মোড়কে ২০টি চকের মূল্য ২০ টাকা।
নীলক্ষেত সিটি করপোরেশন মার্কেটের এনবিএম স্টেশনারিজের শামিম আহমেদ বলেন, স্লেট-চকের বিক্রি তেমন হয় না। কিন্তু ফাউন্টেন পেন-কালির ক্রেতা এখনো আছে। বিক্রিও মন্দ নয়। সবাই তো একরকম নন, কেউ কেউ পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে পছন্দ করেন।