দুরন্ত ঘোড়দৌড়
>

সিলেটের হাওরাঞ্চলে এখন ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড়ের মৌসুম। ‘পঙ্খিরাজ’, ‘সবুজ বাংলা’, ‘টাইটানিক’ কিংবা ‘বাংলার বাঘ’। দৌড়ের ঘোড়ার আছে এমন বাহারি সব নাম। ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় দর্শক গ্রামের সব বয়সী মানুষ। উজ্জ্বল মেহেদী জানাচ্ছেন বিস্তারিত
গ্রামের ধানখেতই এখন যেন খেলার মাঠ। মাঠের মধ্যে কলাগাছ পুঁতে গোলাকার একটি জায়গা চিহ্নিত করা। মানুষজনও গোল হয়ে বসা, কেউবা দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি সবার একদিকেই। মাঠের মাঝখান দিয়ে চলছে ঘোড়া। চলা নয়, এ তো প্রাণপণ ছোটা। পিঠে সওয়াির, থামলেই চাবুকের ঘা। ছুটছে ঘোড়া, ঘুরে ঘুরে। তারপর বাড়তে থাকে গতি। এরই নাম ঘোড়দৌড়।
শুষ্ক মৌসুমে গ্রাম এলাকার দারুণ এক বিনোদন। মৌসুমের এই সময় গ্রামের খালি ধানখেতে বসে ঘোড়দৌড়ের জমজমাট আসর। গ্রামের সব বয়সী মানুষেরা দর্শক। প্রতিযোগিতামূলক এ খেলা শুধু ঘোড়াকে নিয়ে। সঙ্গে মেলাও জমে ওঠে। দিনে ঘোড়দৌড়, রাতে মেলা। চলে গান, যাত্রাপালাও। গ্রামাঞ্চলে ঘোড়দৌড়ের এমন আয়োজন কমে গেলেও সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁও ইউনিয়নের সাতটি গ্রামের উদ্যোগে প্রতিবছর হয় ঘোড়দৌড়। সাত গ্রামের ‘যুব সমাজ’-এর আয়োজনে ২০১১ সাল থেকে হচ্ছে ঘোড়দৌড়।
হাওরাঞ্চলে মেলা আর ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা হয় সিলেটের গোয়াইনঘাট, বিয়ানীবাজার, বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথে। মৌলভীবাজার জেলার হাকালুকি হাওরপারের গ্রামগুলোতেও জনিপ্রয় ঘোড়দৌড়। দৌড়ের জন্য যে মাঠ ব্যবহৃত হয়, নাম ‘খাসমৌজা’।
জায়গাটা গোয়াইনঘাটের আলীরগাঁওয়ে। প্রতিবছর ফাল্গুন মাস থেকে বৈশাখের যে কোনো সময়ে আয়োজন করা হয় ঘোড়দৌড়ের। কখনো বছরে দুই কিংবা তিনবারও এই আয়োজন হয়। আয়োজক বলতে যে সাত গ্রামের ‘যুব সমাজ’ নামের কমিটি থাকে, তাদের মিলিত চেষ্টায় সম্পন্ন হয় ঘোড়দৌড়। মাস তিনেক আগেই শুরু হয় প্রচারণা। ঘোড়া, ঘোড়সওয়ার আর ঘোড়া পালকদের অতিথি হিসেবে বরণ করে নেওয়ার রেওয়াজ আছে ওই সব গ্রামে। দৌড় চালাকালে গ্রামে অতিথির সমাদরে থাকেন ঘোড়দৌড়ে অংশ নেওয়া লোকজন।

এক দলে ৫ ঘোড়া
একটি দলে পাঁচটি ঘোড়া থাকে। অংশগ্রহণকারী সব ঘোড়ার জন্য পুরস্কার হিসেবে থাকে কলস আর ছাতা। দলের মধ্যে প্রথম ঘোড়ার জন্য পুরস্কার একটি ছাগল। পরে সব বিজয়ী ঘোড়া নিয়ে হয় চূড়ান্ত পর্ব। সেখানে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান নির্ধারণ হয়। টানা তিন দিনের ঘোড়দৌড়ের শেষ পর্বে শেষ প্রতিযোগিতায় জয়ীদের নিয়ে চলে জয়োল্লাস।
দৌড়ে ৫০ থেকে ৮০টি ঘোড়া অংশ নেয়। এবার ৫২টি ঘোড়া অংশ নিয়েছে গোয়াইনঘাটের ঘোড়দৌড়ে। কে প্রথম হলো সেটা খেয়াল রাখতে দর্শক সারির সামনে কমিটি নিয়োজিত লোক থাকেন। তাঁরা নির্ধারণ করেন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়।
গোয়াইনঘাটের মাঠে
১৩ মার্চ দুপুর। গোয়াইনঘাটের আলীরগাঁওয়ে গিয়ে দেখা গেল, সর্বশেষ দৌড় শুরুর প্রস্তুতি চলছে। ঘোড়ার মালিক তাঁর ঘোড়া মাঠে দাঁড় করালেন। মুখে লাগানো হলো লাগাম। এবার লাগাম টেনে ধরে পিঠে বসলেন সওয়াির। তুমল করতালিতে শুরু হলো দৌড়।
আলীরগাঁওয়ে এবারকার আয়োজনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন শফিকুর রহমান। জানালেন, সাতটি গ্রামের ঘরপ্রতি সাধ্যমতো অর্থসহায়তা নেওয়া হয়। এ থেকেই প্রতিযোগিতার তিন দিনের খরচ মেটানো হয়। খরচ বলতে ঘোড়ার মালিকদের তিন দিনের বাসস্থান ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা। রাতে ঘোড়দৌড় উপলক্ষে মেলার আয়োজন হলে সেখানে কেনাবেচা থেকে আয়োজকদের বাড়তি আয় হয়। শফিকুর বলেন, ‘আমরা ছোট থাকতে বাপ-দাদার আমলে যেভাবে ঘোড়দৌড় অইতে দেখছি, ঠিক সেইভাবেই করছি। এইটা একটা ঐতিহ্য, আমরা চাই বংশপরম্পরায় হউক।’

ঘোড়ার নাম তামিম!
দৌড়ে আসে সাদা, কালো, লাল, চিত্রা হরেক রঙের ঘোড়া। কিন্তু এসব ঘোড়াকে কেউ ‘ঘোড়া’ বলে ডাকে না। স্বভাব আর চরিত্র ভেদে নাম থাকে নানা রকম। ‘পঙ্খিরাজ’, ‘সবুজ বাংলা’, ‘টাইটানিক’, ‘বাংলার বাঘ’, ‘টাইগার’, ‘হাওয়াই’, ‘রংবাজ’, ‘কালিয়া’, ‘মাঠের রাজা’সহ নানা নামে তাদের পরিচিতি। আলীরগাঁওয়ে এবার ঘোড়দৌড়ের আয়োজন হয় ১০ থেকে ১৩ মার্চ। শেষ দিনের ঘোড়দৌড়ে মাইকে একটি ঘোড়ার নাম শুনে চমকে উঠলাম। ঘোড়ার নাম নাকি ‘তামিম’! সওয়ারির গায়েও বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের জার্সি। গোয়াইনঘাটের বাসিন্দা জৈন্তাপুর কারিগরি কলেজের কম্পিউটার প্রদর্শক মনজুর আহমদের ধারণা দর্শকদের নজর কাড়তেই ক্রিকেটার তামিম ইকবালের নামে এই নামকরণ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এসব ঘোড়ার নামকরণ আসলে সময় ভেদে বদলায়। আগে জনপ্রিয় যাত্রাপালা, বাংলা সিনেমা বা সাহসী কোনো চরিত্রের নামে নামকরণ করা হতো বেশি। এখন ক্রিকেট-তারকাদের নাম ঘোড়দৌড়েও প্রবেশ করেছে!’