দূরের ভালোবাসা কত দূর

‘তুমি থাকো সিন্ধু পারে, ওগো বিদেশিনী’! রবীন্দ্রসংগীতের এই একটি লাইন শুনলেই বোঝা যায়, কোনো এক প্রেয়সী রয়েছেন সমুদ্রের ওপারে। আর কবি এপারে। মাঝে বিস্তর ব্যবধান। তাই হয়তো কবিগুরু কুষ্টিয়ার শিলাইদহে বসেই গানটি লিখে রেখেছিলেন তাঁর ডায়েরিতে।
এত বছর পরেও গানটি গুণগুণ করে আমরা গেয়ে চলি। কেননা, একালে আমাদের অনেকের প্রিয় মানুষ কিন্তু থাকেন সিন্ধুর ওপারে। খুব কাছ থেকে দেখা মেলে বছর দু-এক পর। উচ্চশিক্ষা কিংবা কর্মব্যস্ততা, বিভিন্ন কারণে অনেকেরই পাড়ি জমাতে হয় বিভিন্ন মহাদেশে। আর প্রিয় মুখটি হয়তো অপেক্ষায় থাকেন প্রিয় মানুষটির জন্য। অনেকেই দূরত্ব ঘুচিয়ে প্রণয়ে রূপ দেন প্রেমকে।
দূরত্বের সম্পর্কে সমস্যা
ভৌগোলিক অবস্থানগত বেশি দূরত্বের কারণে সম্পর্কে সমস্যা হতেই পারে। এমনটাই মনে করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের কাউন্সেলর নুসরাত জাহান। তিনি বলেন, যেকোনো সম্পর্কে যোগাযোগ প্রয়োজন। হতে পারে পারিবারিক কিংবা প্রেমের সম্পর্ক। যোগাযোগের মাধ্যমেই সমস্যাগুলো বেরিয়ে আসে। একই সঙ্গে মেলে সমাধানও। কিন্তু যেহেতু বেশি দূরত্বের সম্পর্কে ব্যবধানটা বেশি, তাই যোগাযোগ অনেক সময় কমে যায়। সেই সঙ্গে দেখা করা কিংবা নৈকট্য—সেটাও সম্ভব নয়। তাই সামান্য কারণেই হয়তো অভিমানটা বেশি হয়ে দাঁড়ায়।
নুসরাত জাহান সাধারণ কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়েও বলেন, প্রযুক্তি যেমন অনেক কিছুরই সমাধান জুগিয়েছে, তেমনি বিভিন্ন সমস্যাও তৈরি করেছে। আপনি হয়তো অধীর আগ্রহে বসে আছেন ল্যাপটপের সামনে। ঠিক এই সময়েই যে ভিডিও কল আসার কথা। কোনো কারণে হয়তো মোবাইলের রিংটোনটাও বেজে উঠল না। ‘তাহলে কি আমার সময়ের কোনো গুরুত্ব নেই?’ এমন বিভিন্ন প্রশ্ন মনে এসে যায়। আর ফলাফল হিসেবে তৈরি হয় সম্পর্কে দূরত্ব!
আজ যাকে বিশ্বাস করে দূরদেশে পাড়ি জমালেন, কোনো কারণে হয়তো সেই মানুষটির ওপর সন্দেহ জন্ম নিল। হয়তো আপনার অপছন্দের কারও সঙ্গেই প্রিয় মানুষটি কোথাও বেড়াতে গেল। ব্যস, অমনি শুরু হয়ে গেল রাজ্যের যত সন্দেহপ্রবণতা। একটা পর্যায়ে তর্কাতর্কি, তারপর যোগাযোগ বন্ধ থেকে একেবারেই সম্পর্কের ইতি।
আবার এমনও দেখা যায়, অনেকেই হয়তো একাকিত্ব মেনে নিতে পারেন না। তাই ধীরে ধীরে তৃতীয় কোনো পক্ষের প্রতিও দুর্বল হয়ে পড়েন।

পরিসংখ্যান যা বলে
দুজনের মধ্যে দীর্ঘ পথের দূরত্ব বলে মন খারাপ করছেন? জেনে নিন আপনি কিন্তু একাই এ ধরনের সম্পর্কে নেই। এমনকি হাতে গোনা কজনও নয়, প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ যুগল ‘লং ডিসটেনস রিলেশনশিপ’-এ রয়েছেন। হ্যাঁ, এমনটাই জানা গেছে গত বছরের এক গবেষণার ফল থেকে। গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। এমনকি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে যে এ ধরনের সম্পর্ক কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুবই ফলপ্রসূ। কীভাবে? দীর্ঘ দূরত্বের কারণে দুজনের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ অনেকটাই কমে যায়। ফলে পছন্দের মানুষের প্রতি ভালোবাসাটা বাড়তেও পারে।
এ তো গেল সম্পর্কের ভালো দিক। তাই বলে বিপরীত দিকও কিন্তু রয়েছে। গবেষণা থেকেই না হয় বলা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও অঙ্গরাজ্যে পরিচালিত এক গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে এক-তৃতীয়াংশ যুগলই নিজেদের মধ্যকার দীর্ঘ দূরত্ব মেনে নিতে পারেন না। আর ফলাফলটা বুঝতেই পারছেন! সম্পর্কের অবসান। তবেই চাইলে সহজেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায়। আর তা দুজনে মিলেই।
>এমন দূরত্বের সম্পর্কে কিছু বিষয় মেনে চলুন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুলতানা আলগিন সম্পর্কটাকে আরও বিস্তৃত পর্যায়ে দেখেন। তিনি বলেন, ‘অধিক দূরত্বের সম্পর্ক কিন্তু শুধু অবিবাহিত যুগলের মধ্যে হবে তা তো না। বিবাহিত দম্পতির মধ্যেও এমন অবস্থা মাঝেমাঝে হতে পারে। আমাদের দেশেও এ রকম বেশি দূরত্বের মন সচরাচর দেখা যায়।’
এ ধরনের সম্পর্কে কিছু সমস্যাও রয়েছে বলে জানালেন সুলতানা আলগিন। তিনি বললেন, ‘দেখা গেল বিদেশে থাকেন একজন পুরুষ। আর তাঁর স্ত্রী রয়ে গেছেন দেশেই। নিয়মিত যোগাযোগ হলে তো ভালো, না হলে সম্পর্কের প্রতি দুজনেরই একটা অনীহা চলে আসতে পারে। আর এ জন্যই নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াটাও অস্বাভাবিক কিছু না।’
তাঁর পরামর্শ—সম্পর্কে কখনোই দূরত্ব তৈরি করা যাবে না। হ্যাঁ, দীর্ঘদিনের সম্পর্কে একঘেয়েমি চলে আসে। সম্পর্কটি যদি টিকিয়ে রাখতেই হয় তবে নিজেকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি সঙ্গীকেও সময় দিন। যুগলের মধ্যে দুজনেরই সমান স্বাধীনতা থাকতে হবে।
একে অপরকে বোঝা
আপনি যদি পাশের মানুষটিকে না-ই বুঝতে শেখেন, তাহলে চলার পথটা বন্ধুর হয়ে পড়ে। অন্যান্য দিন এই সময়ে কল দেওয়ার মানে এই নয় যে আজকেও আপনাকে ঠিক একই সময়ে কথা বলতে হবে। অপর ব্যক্তিটি হয়তো কোনো কাজে রয়েছেন। সম্পর্ক যত দিনেরই হোক না কেন, দুজনের মধ্যেই একটা আলাদা জগৎ থাকতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে পাশের মানুষকে চলতে দিন তাঁর মতো।
বিশ্বাস রাখা
যদি ভালোবাসার মানুষটিকে বিশ্বাস না-ই করতে পারেন, তাহলে বাকি জীবনটা চলবেন কী করে? অযথাই সন্দেহ করা ঠিক নয়। যদি তাঁর কোনো ব্যাপার আপনার ভালো না লাগে, তাহলে তাঁকে বুঝিয়ে বলুন। প্রতিটি মানুষই নিজের মতো স্বতন্ত্র।
চাই নিয়মিত যোগাযোগ
দূরত্ব রয়েছে তো কী হয়েছে? স্থানের দূরত্ব ভুলে মানসিক নৈকট্য বজায় রাখুন। সব সময়ই না হোক, অন্তত কিছু নির্দিষ্ট দিন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তাঁকে বুঝতে দিন, যে তিনি আপনার কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ কোনো দিনে তাঁর জন্য পাঠাতে পারেন কোনো উপহার। আর সামাজিক মাধ্যম তো রয়েছেই।
তৃতীয় পক্ষ থেকে দূরে থাকা
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তৃতীয় কোনো পক্ষের কারণেই সম্পর্কে বিবাদের সৃষ্টি হয়। তাই নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা কিংবা অযথা তৃতীয় পক্ষের কারণে সন্দেহ না করাটাই ভালো।
চাই একটু সময়
হয়তো নিজেরা আলোচনা করেও ফল মিলছে না। ঠিক আছে, দুজনেই একটু সময় নিন। একঘেয়েমি কাটাতে দুজনেই নিজের পছন্দের কাজ করতে পারেন। কিংবা নিজ বন্ধুমহলের সঙ্গে বেড়িয়ে আসতে পারেন। এতে মনটাও হালকা হবে, নিজেরাও নিজেদের বুঝতে পারবেন।
আগে নিজেকে বুঝতে শিখুন
আমাদের তো কত অভিযোগই থাকে পাশের মানুষটির প্রতি। তাই বলে কি নিজেদের কোনো দোষ নেই? তাই সবার আগে দরকার নিজেকে বোঝার। আপনি ভেবে দেখুন, আপনার কোনো আচরণে প্রিয় মুখটি মলিন হয়ে পড়ছে। সেই বিষয়টি এড়িয়ে চলুন। এই সামান্য বিষয়টি মেনে চললেই কিন্তু সম্পর্কের বিবাদ মিটে যাচ্ছে।