ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে কসপ্লে

কসপ্লেকে বলা যায় ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’। এখানে কসপ্লেয়াররা হয়ে যান পরিচিত চরিত্রগুলো, যাঁদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় কমিক বই, কার্টুন, টিভি সিরিজ কিংবা সুপারহিরো চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। কসপ্লেয়াররা কেবল চরিত্র ধরে সাজেন তা নয়, চরিত্রের ভেতরে ঢুকে উঁকি দেন তাঁরা।

কাজী নূর হয়েছেন অ্যাকুয়াম্যান
ছবি: সংগৃহীত

সময়ের সঙ্গে কসপ্লের জনপ্রিয়তা পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের তরুণদের ঘরে, মনে। সহজ কথায় কসপ্লে মানে কস্টিউম প্লে, বলা যায় পোশাকের খেলা। আর যিনি এই শিল্পের চর্চা করেন, তিনিই কসপ্লেয়ার। কসপ্লেয়ারদের কখনো দেখা যায় গোয়েন্দা শার্লক হোমস সেজে হ্যারি পটারকে পরামর্শ দিতে, ব্যাটম্যানকে দেখা যায় ‘ম্যাট্রিক্স’ সিনেমার নিওর সঙ্গে আড্ডা দিতে। ডিজনির প্রিন্সেস এলসা আর অ্যানিমে চরিত্র নারুটোকেও দেখা যায় দুই বন্ধু একসঙ্গে সেলফি তুলছেন! ছোটবেলায় যিনি ভাবতেন স্পাইডারম্যান হবেন, বড় হয়ে কসপ্লেয়ার হয়ে সেই সাধ মেটাচ্ছেন তিনি।

জনপ্রিয় সব কাল্পনিক বা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’, এমনকি নিজের বানানো চরিত্রগুলো হয়ে উঠতে অনেক সময়ে কসপ্লেয়ারকে ওই চরিত্র যে কারণে বিখ্যাত, সেটি নিজের ভেতরে ধারণ করতে হয়। অভিনয় দক্ষতাসহ নাচ, গান আর অ্যাকশনেও পারদর্শী হতে হয় তাঁকে। আর এজন্য যে পোশাক, অনুষঙ্গ (প্রপস) ও রূপসজ্জা দরকার, সেসবও নিজের হাতেই করেন একজন কসপ্লেয়ার। অনেক সময়ে নিজের মডেলকে নিজের শিল্পে সাজিয়ে একটি কল্পিত চিত্রকে বাস্তবে রূপ দেন তিনি। অনেক দেশেই জনপ্রিয় শিল্পগুলোর প্রথম সারিতে কসপ্লের অবস্থান। বিশ্বের বড় বড় বিনোদনশিল্পে কসপ্লেয়াররা সিনেমা আর টেলিভিশন সিরিজে পোশাক তৈরি করেন।

দেশী কসপ্লেয়ারদের একাংশ একসঙ্গে দেখেছেন ‘অ্যাভেঞ্জার্স এন্ডগেম’
ছবি: সংগৃহীত

কসপ্লেয়াররা একটি চরিত্রের খুঁটিনাটি নিয়ে নিখুঁতভাবে কাজ করেন। আর সেই চরিত্রটা হয়ে ওঠেন বা উপস্থাপন করেন। একজন কসপ্লেয়ার যা–ই পরুন না কেন, তাঁর অনুমতি না নিয়ে তাঁকে স্পর্শ করা যাবে না। অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করে কোনো অবস্থায় তাঁকে হেয় করা যাবে না।

বাংলাদেশে অন্তত এক দশক ধরে চলছে কসপ্লে শিল্পের চর্চা। ২০১০–২০১১ সাল থেকে পপ সংস্কৃতির চর্চা করে, এমন অনেকে গ্রুপের আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিজের পছন্দের চরিত্র সেজে আসতে শুরু করেন কিছু কসপ্লে শিল্পী। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা কমিকন। তারপর থেকেই কসপ্লে শিল্প খানিকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। তখন থেকে কমিকন উৎসবের মূল আকর্ষণ কসপ্লে! ২০১২ সালে বাংলাদেশের প্রথম পপ কালচার কনভেনশন আয়োজনের মধ্য দিয়ে কসপ্লে চর্চা করার পথটি যেন আরেকটু সুগম হয়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম কসপ্লে গোষ্ঠী ‘বিডি কসপ্লেয়ারস’। এরপর অনলাইনভিত্তিক বিদেশি কিছু কসপ্লে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়ে আলোচনায় আসেন বাংলাদেশের কসপ্লেয়াররা।

কসপ্লেতে পুরস্কারও আসছে
ছবি: সংগৃহীত

‘বিডি কসপ্লেয়ারস’ কসপ্লেকে একটি পরিপূর্ণ শিল্প হিসেবে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত কসপ্লে প্রতিযোগিতা ও কসপ্লে কর্মশালার আয়োজন করে আসছে। এর মধ্যে ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট জোসেফ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নটর ডেম কলেজ, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখযোগ্য।

নাফিসা রাশেদ হয়েছেন ডিজনির ‘ট্যাংলেড’ ছবির জনপ্রিয় চরিত্র রাপুনজেল
ছবি: সংগৃহীত

এ ছাড়া বিডি কসপ্লেয়ারের শিল্পীরা পেশাগতভাবে পোশাক ও প্রপস তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে জড়িত আছেন। যমুনা ফিউচার পার্কের সঙ্গেও রয়েছে বিডি কসপ্লেয়ারসের দীর্ঘ পথ চলার ইতিহাস। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রপস তৈরির জনপ্রিয় সব চরিত্র বাস্তবায়ন করে আসছেন কসপ্লেয়াররা। এ ছাড়া বেশ কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতাও আছে তাঁদের ঝুলিতে।

বিডি কসপ্লেয়ারসের সহপ্রতিষ্ঠাতাদের একজন কসপ্লেয়ার কাজী নূর। কেন করেন কসপ্লে? উত্তরে এই কসপ্লেয়ার বলেন, ‘একটি চরিত্রের সুন্দর চিত্রায়ণ দেখে হয়তো অনেক মানুষের ভালো লাগে। তবে সবার শুধু এই দেখে ভালো লাগার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, নিজেই হয়ে উঠতে চান চরিত্রটি। শত বছর ধরে বিভিন্ন দেশে এ ধরনের প্রচেষ্টা চলেছে। এই ভালো লাগার জায়গাটা নিয়েই আমরা কাজ করছি। সমমনা মানুষদের সঙ্গে নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে হাঁটতে শুরু করেছি সেই পথে। আমাদের কাছে যেমন জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে “বাকের ভাই” রয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। কেউ হয়তো চরিত্রটিকে ভালোবেসে হয়ে উঠতে চান বাকের ভাই। কিন্তু সাধারণভাবে রোজকার জীবনে বাকের ভাই সাজার কোনো স্থান নেই, উপলক্ষ্য নেই। তাই বাকের ভাই হয়ে ওঠার ইচ্ছাটা ঠিক পূর্ণতা পায় না। এমন ইচ্ছা যাঁরা পোষণ করেন মনের গহিনে, তাঁদের মতো মানুষদের নিয়েই আমাদের এই পথচলা।’ এই কসপ্লেয়ার আরও জানান, প্রতিবছর পপ সংস্কৃতিপ্রেমীদের জন্য আয়োজন করা হচ্ছে ‘ঢাকা গিক কনভেনশন’। আন্তর্জাতিক পরিসরে এই সংস্কৃতির আদান-প্রদানের পুরো দুয়ারও উন্মুক্ত আজকের পৃথিবীতে।

প্রিয় চরিত্রের ছদ্মবেশে অর্ক রায়
ছবি: সংগৃহীত

২০১৫ সালে থাইল্যান্ডে আয়োজিত ‘ব্যাংকক কমিক কনভেনশন এক্স এনেমে ফেস্টিভ্যাল, এশিয়া’ শিরোনামের কসপ্লে প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়ে বাংলাদেশের কসপ্লেকে সফলভাবে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেন কাজী নূর। জিসান তানভীর, অর্ক রায়, নাফিসা রাশেদরাও বিডি কসপ্লেয়ারসের সহপ্রতিষ্ঠাতা। তাঁরা প্রত্যেকে কসপ্লেকে কেবল দেশেই নয়; বরং দেশের বাইরেও কসপ্লে সোসাইটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। কসপ্লেকে জনপ্রিয় করতে দেশের কসপ্লেয়ারদের কাছে পরিচিত মুখ তাঁরা।