ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে কোনো সমাধান নয়
ছেলেটি ১৫ বছর বয়সী মেয়েটিকে বিয়ে করবেন বলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়। তবে এ কথা যাতে কেউ না জানে, জানলে ছেলেটির বিদেশ যাওয়া আটকে যাবে, এতে দুজনের ভবিষ্যৎই নষ্ট হবে বলেও মেয়েটিকে ভোলানো হয়েছিল। একবার বিদেশ যেতে পারলে তখন ছেলেটিই পরিবারের সদস্যদের (ছেলের মা জানতেন) বিষয়টি জানাবেন। মেয়েটি ওই ছেলেকে বিশ্বাস করেছিল।
গর্ভের সন্তানের বয়স যখন পাঁচ মাস, তখন তা জানাতে বাধ্য হয় মেয়েটি। মেয়ের পরিবার আইনের আশ্রয় নিতে চায়। গ্রামবাসী সমঝোতায় এগিয়ে আসেন। ছেলের পরিবারও বিয়েতে রাজি হয়। বিদেশে থাকা ছেলের সঙ্গে মুঠোফোনে ইমোর মাধ্যমে বিয়ে হয়। বিয়ের লিখিত কাবিননামাও করা হয়।
মেয়েটির বাবা প্রথম আলোকে বললেন,‘নাতির বয়স এখন আড়াই বছর। বিয়ের পর থেকে মেয়েকে পালছি। এখন মেয়ে ও নাতি দুজনকেই টানছি। মেয়ের সঙ্গে জামাই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে সেই বিয়ের পর থেকেই। আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার এই নাতির বাবা কে, তা নিয়ে উল্টো প্রশ্ন তুলছে। তখন বিয়েতে মত দিয়েছিল শুধু তাদের ছেলেকে বাঁচানোর জন্য। এখন আমি মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছি।’
১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় থাকা এই বাবার সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হয়। গ্রামের বাড়িতে থাকা মেয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে ন্যায়বিচার চেয়ে আবেদন করেছে। আবেদনের বিভিন্ন নথি দেখালেন বাবা। মেয়েকে ছেলেটি ধর্ষণ করেছেন এবং তখনই কেন তিনি আইনের আশ্রয় নেননি, সে আক্ষেপ এই বাবার কণ্ঠে।
আদালতে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে
সম্প্রতি আদালত প্রাঙ্গণে ধর্ষকের সঙ্গে একাধিক বিয়ের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানের ভবিষ্যৎ বা শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৪ নভেম্বর কুমিল্লার আদালতে ধর্ষণ ও পর্নোগ্রাফি মামলার আসামির (৩০) হাতকড়া পরা অবস্থায় বিয়ে হয়েছে। এ বিয়ের দেনমোহর ১০ লাখ টাকা। বিয়ের এক দিন পর কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ওই আসামি জামিনে মুক্তি পেয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে গেছেন।
২০১৫ সালে এক সৌদি আরবপ্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে ওই আসামির মুঠোফোনে পরিচয় হয়। প্রেম ও পরে ব্যক্তিগত কিছু দৃশ্য ভিডিও করে রাখেন ওই ব্যক্তি। ভিডিও দেখিয়ে অন্তত ১০ লাখ টাকা হাতিয়েও নেন। আরও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করলে না দিলে ওই ভিডিও প্রবাসী স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠান। গৃহবধূর স্বামী তাঁকে গত অক্টোবরে তালাক দেন। ওই নারী চৌদ্দগ্রাম
থানায় ধর্ষণ ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে বিয়ের শর্তে আপস হয়। কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ মো. আতাব উল্লাহ আপসের শর্তে ওই ব্যক্তিকে জামিন দেন এবং আদালত প্রাঙ্গণে বিয়ের নির্দেশনা দেন।
১৯ নভেম্বর ফেনী জেলা কারাগারে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগী তরুণীর বিয়ে হয়। মিষ্টি নিয়ে দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজনসহ আইনজীবীরা কারাগারের ফটকে হাজির হন ও বিয়ের পর দুই পক্ষ কোলাকুলিও করেন। ফেনী জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মনিরুজ্জামানের উপস্থিতিতে ৬ লাখ টাকা দেনমোহর এবং ১ লাখ উশুল ধার্য করে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের আদালত আসামিকে জামিন না দিয়ে কারাফটকে বিয়ের আয়োজন করার জন্য ফেনী কারাগারের তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দেন। পরে ৩০ নভেম্বর ওই আসামির এক বছরের জন্য জামিন দেন আদালত।
১৯ নভেম্বর নাটোরের আদালত চত্বরে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে আরেকটি বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বিয়ের প্রলোভনে ধারাবাহিক ধর্ষণের অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছিল। বিয়ের পর আদালত ওই আসামির জামিন মঞ্জুর করেন। নাটোর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি সিরাজুল ইসলাম আসামির জামিন হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, বিয়ের ব্যাপারে আদালতের কোনো ভূমিকা ছিল না। এটি উভয় পক্ষের অভিভাবকদের ব্যাপার।
এর আগে চলতি বছরের ২২ অক্টোবর ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ও ভুক্তভোগী মেয়ের কারাফটকে বিয়ের আয়োজন করতে রাজশাহী কারাগারের তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। আর বিয়ের পর লিখিতভাবে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার পরই আসবে জামিনের বিষয়টি। ভুক্তভোগী মেয়েটি যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন বয়স ছিল ১৪ বছর। অন্যদিকে ২০১২ সালের রায়ের পর থেকে আসামি কারাগারে আছেন।
গত বছরের অক্টোবর মাসে লালমনিরহাটে ধর্ষণের শিকার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীকে অভিযুক্ত ধর্ষকরে সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার অভিযোগে কাজিকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। ধর্ষণের পর এই কিশোরীর গর্ভপাতও করানো হয়েছিল। ক্লিনিকে রেখেই পালিয়ে গিয়েছিলেন ধর্ষক। প্রথম আলোর প্রকাশিত সংবাদ বলছে, এ বিয়ের ঘটনায় লালমনিরহাট সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাইনুল ইসলাম জড়িত ছিলেন বলে কিশোরীর পরিবার অভিযোগ করেছিল। তবে বিয়ের কোনো দালিলিক প্রমাণ রাখা হয়নি এবং ধর্ষক পরে কিশোরীকে তালাকও দিয়ে দেন।
২০১৭ সালের মার্চ মাসে বিশেষ বিধান রেখে বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার চার সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রাম আদালতে একটি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে। বর ছিলেন ধর্ষণ মামলার আসামি। বিয়ের পর আসামি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে প্রসঙ্গে সরকারের প্রধান ও মুখ্য আইন পরামর্শক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করে আসামিকে যথাযথ শাস্তি দিতে হবে। ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে হলেও ধর্ষণ মামলা থেকে আসামি রেহাই পাবেন না। আইনে ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানের সুরক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা বলা আছে।
আছে আইনি সুরক্ষা
বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩–এ যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। ধর্ষণের ঘটনায় ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আইন অনুযায়ী, যে সন্তানের জন্ম হবে, তার মা অথবা মায়ের দিককার আত্মীয়স্বজনের তত্ত্বাবধানে রাখা যাবে। এ সন্তান বাবা বা মা অথবা উভয়ের পরিচয়ে পরিচিত হবে। সন্তানের ২১ বছর বয়স পর্যন্ত ভরণপোষণের ব্যয় রাষ্ট্র বহন করবে। কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত এবং প্রতিবন্ধী সন্তান হলে সে যত দিন নিজে ভরণপোষণের যোগ্যতা অর্জন করতে না পারবে, তত দিন সে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সহায়তা পাবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেই বলা আছে, সন্তানের ভরণপোষণের জন্য সরকার ধর্ষকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারবে। ধর্ষকের বিদ্যমান সম্পদ থেকে সেই অর্থ আদায় করা সম্ভব না হলে, ভবিষ্যতে তিনি যে সম্পদের মালিক বা অধিকারী হবেন, সেই সম্পদ থেকে তা আদায়যোগ্য হবে।
চলতি বছরের ১৪ অক্টোবর টাঙ্গাইলে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তরুণীকে ধর্ষণের দায়ে এক যুবককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং একই সঙ্গে ওই যুবককে ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানের ভরণপোষণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সন্তানের ভরণপোষণ না দিলে ধর্ষকের বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশনা দেওয়া হয়।