নতুন মায়ের কাজে ফেরা

কাজ থেকে ফিরে তো ছোট্ট শিশুর সঙ্গেই কাটবে সময়। ছবিতে তুর্জি ও তাঁর ছেলে রাসিন।
ছবি: খালেদ সরকার

বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সিরাজুম মুনিরা। মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছেন প্রায় চার মাস। সেই মেয়াদ শেষ। ছোট্ট শিশুকে বাসায় রেখে কাজে ফিরতে হবে আগামী মাসে। কী করে সামলাবেন সেই সময়টা, এই ভাবনাতেই একশা হচ্ছেন তিনি। যদিও শিশুকে দেখেশুনে রাখার জন্য ভরসা জায়গা তাঁর মা আছেন। তবুও এত ছোট সন্তান, সংসার, কর্মক্ষেত্র, সদ্য মা হওয়ার ধকল সব মিলিয়ে যেন চেনা জগতে অচেনাভাবে পা রাখা।

কর্মজীবী মায়েদের নতুন সন্তানকে রেখে কাজে ফিরতে মানসিক টানাপোড়েনে ভুগতে হয়। অনেকে হয়ে পড়েন বিষাদগ্রস্ত। সরকারি চাকরিজীবী মায়েরা ৬ মাস ছুটি পেলেও বেসরকারি চাকুরেদের বেলায় ৩-৪ মাসের বেশি ছুটি মেলা ভার। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান অবশ্য সরকারি নিয়ম মেনেই ছুটি দেয়। এরপরও এই ছুটির পর কাজে যোগদানে মায়ের সবচেয়ে বেশি যে দুশ্চিন্তা, সেটি হলো শিশুর দেখাশোনা কে করবে।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তাহমিনা বেগম বলেন, ‘শিশুকে পূর্ণ ছয় মাস কেবল বুকের দুধই পান করানো উচিত। শিশুর বয়স ৬ মাস পেরিয়ে গেলে বুকের দুধের পাশাপাশি বাসায় তৈরি করা সব ধরনের খাবার শিশুকে একটু একটু করে খেতে দেওয়া উচিত। শিশু যদি ২৪ ঘণ্টায় ৬ বার প্রস্রাব করে, বুঝতে হবে, শিশু ঠিকমতো বুকের দুধ পাচ্ছে। কর্মজীবী মায়েদের কাজে ফেরার জন্য সরাসরি মায়ের বুক থেকে দুধ পান করানো সম্ভব না হলেও মায়ের স্তন চেপে বা ব্রেস্ট পাম্প জীবাণুমুক্ত করে ধুয়ে পাম্প করে দুধ বের করে একবার পান করার পরিমাণ বুঝে কয়েকটি আলাদা আলাদা কাপে করে সংরক্ষণ করতে হবে। যাতে প্রতিবার একটি কাপের দুধ শেষ করতে পারে।’ এই বিশেষজ্ঞের আরও পরামর্শ আছে ছোট্ট শিশুর দেখাশোনার বিষয়ে।

শিশুর খাবার সময় হলে পরিষ্কার চামচের সাহায্যে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করাতে হবে। যখন মা বাসায় থাকেন, শিশুকে এক পাশের বুকের দুধ পান করানোর সময় অন্য পাশের বুকের দুধ সংরক্ষণ করতে হবে। এমনি রাখলে ৬ ঘণ্টা আর ফ্রিজে সংরক্ষণ করলে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বুকের দুধের গুণ অটুট থাকে। যেভাবেই সংরক্ষণ করা হোক না কেন, যখন শিশুকে দুধ পান করানো হয়, তখন একটা পাত্রে কুসুম গরম পানি নিয়ে তাতে দুধের কাপ চুবিয়ে রাখতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে দুধ হালকা গরম হয়ে যাবে, সেটি চামচের সাহায্যে শিশুকে দিতে হবে। কোনোভাবেই ফিডারে নয়।

 কর্মস্থল বাড়ির কাছাকাছি হলে যেকোনো একসময় এসে শিশুকে বুকের দুধ দিতে পারলে খুব ভালো। মাকে বেশি বেশি করে খাবার খেতে হবে। এতে শিশুর জন্য পর্যাপ্ত খাবার তৈরি হবে। মাকে মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হবে, উৎফুল্ল থাকতে হবে, হাসিখুশি থাকতে হবে। যেহেতু মা চাকরিজীবী, কাজের ও শিশুর যত্নের ফাঁকেও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। খুব জরুরি বিষয়, মাকে প্রতিদিন গোসল করতে হবে, একবার গোসলই যথেষ্ট। অনেকেই প্রতিবার খাওয়ানোর আগে স্তন ধুয়ে ফেলেন, যেটি একেবারেই ঠিক নয়। তাতে শিশু মায়ের গায়ের গন্ধ খুঁজে পায় না, মাকে চিনতে শিশুর অসুবিধা হতে পারে।

একই ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফাতেমা ফেরদৌস। তিনি যোগ করেন, ‘শিশুর খাবারের পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতাও খুব জরুরি। বাইরে থেকে ফিরেই সাবান–পানিতে হাত না ধুয়ে বা জীবাণুনাশক দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত না করে শিশুকে কোলে নেওয়া যাবে না। শিশুকে দিনের বেলা ডায়াপার না পরিয়ে রাখাই সুবুদ্ধির পরিচয়। ক্লান্ত চাকুরে মায়ের ঘুমের কিছুটা সুবিধার জন্য রাতে ডায়াপারে ভরসা রাখাই ভালো।’

  • ডায়াপার যেন অতিরিক্ত আঁটসাঁট না হয়। আরামদায়ক ও উচ্চ শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়াটা জরুরি। ডায়াপারে ঢাকা অংশে র‌্যাশ বের হচ্ছে কি না বা লাল হয়ে যাচ্ছে কি না, খেয়াল রাখতে হবে। ডায়াপার ভারী হলেই জায়গাটা পরিষ্কার করে নতুন ডায়াপার পরাতে হবে।

  • ছোট শিশুরা সাধারণত সামনে যা পায়, তা–ই মুখে দেয়। তাই শিশুর সামনে থাকা প্রতিটি জিনিস পরিষ্কার থাকা উচিত। কোনো খেলনা শিশুর সামনে দিলে, সুচালো, খড়খড়ে বা এবড়োখেবড়ো খেলনা না দেওয়া উচিত। মুখে ঢুকে আটকে যেতে পারে, এমন কিছুর সামনে থেকে শিশুকে দূরে রাখতে হবে।

  • শিশুর দেখভালের দায়িত্বে যিনিই থাকুন না কেন, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বিষয়গুলো তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুকে খুব বেশি সময় কোলে না রেখে স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার পরিবেশ দিতে হবে।

  • বিছানা বা উঁচুতে রাখলে শিশু পড়ে গিয়ে ব্যথা পেতে পারে। আবার সরাসরি মেঝেতেও শিশুকে শুইয়ে বা বসিয়ে রাখা উচিত নয়। মেঝেতে বিছানা পেতে সমাধান করা যেতে পারে এমন সমস্যার। আর মায়ের হাসিখুশি, দুশ্চিন্তামুক্ত থাকাটা খুবই জরুরি।